একজন সত্যিকার সফল উদ্যোক্তা তাঁর ব্যবসার উন্নয়নের পাশাপাশি নিজেকেও সব সময়ে উন্নত করার চেষ্টা করেন। সফল উদ্যোক্তা হওয়ার উপায় হিসেবে এর কোনও বিকল্প নেই।
সফল উদ্যোক্তা হতে পারা অবশ্যই দারুন, কিন্তু সেই পথে চ্যালেঞ্জও কম নয়।আর এই চ্যালেঞ্জ জয় করতে সব সময়ে নিজেকে উন্নত করার বিকল্প নেই । বেশিরভাগ সফল উদ্যোক্তা খুবই উৎসাহী ও আশাবাদী ধরনের মানুষ। সেই সাথে তাঁরা জানেন যে, ব্যবসার উন্নতি ঘটানোর পাশাপাশি নিজের দক্ষতা ও জ্ঞানের উন্নতি করা কতটা দরকার।
পৃথিবীর সেরা উদ্যোক্তাদের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাঁরা সব সময়েই নিজেদের আপগ্রেড করার জন্য নতুন নতুন জ্ঞান ও দক্ষতা শেখার চেষ্টা করেন। প্রতিযোগীতায় টিঁকে থাকতে এবং ব্যবসাকে এগিয়ে নেয়ার এটাই সেরা উপায়। শুধু ব্যবসার পেছনে বিনিয়োগ করার বদলে যিনি ব্যবসাটি চালাচ্ছেন, তাঁর পেছনেও বিনিয়োগের দরকার আছে। উদ্যোক্তা নিজে যত উন্নত হবেন, তাঁর ব্যবসাও তত উন্নত হবে।
নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিমাপ করা, নিজের দুর্বল জায়গা গুলো খুঁজে বের করা, দুর্বলতাগুলো দূর করার জন্য নতুন কিছু শেখা – ইত্যাদি কাজ একজন সত্যিকার সফল উদ্যোক্তা সব সময়েই করতে থাকেন।
০৫. যোগাযোগ দক্ষতা
আপনি যে ব্যবসাই করতে চান না কেন, আপনাকে অবশ্যই কমিউনিকেশনে ভালো হতে হবে।
ক্রেতাদের ইমপ্রেস করা, টিম মেম্বারদের ম্যানেজ করা, ইনভেস্টর ধরে আনা, টাকা ধার করা, ব্যাঙ্কের সাথে সম্পর্ক তৈরী করা, কর্মীদের দিয়ে সেরাটা বের করে আনা – অর্থাৎ একটি নতুন ব্যবসার প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষ যোগাযোগের প্রয়োজন হবে।
মানুষের সাথে কথা বলতে আপনার যদি সমস্যা হয় – তাহলে উদ্যোক্তা হিসেবে আপনার সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু এর মানে এই নয়, আপনার পক্ষে সফল হওয়া সম্ভব নয়। হয়তো মানুষের সাথে কম মেশেন বলে মানুষের সাথে সেভাবে কথা বলতে পারেন না; অথবা পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশের কারণে আপনি তেমন মিশুক হয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু এগুলো একটু চেষ্টা করলেই শেখা সম্ভব।
উদ্যোক্তা হতে হলে ব্যবসা শুরুর আগেই যোগাযোগে অনেকটা দক্ষ হয়ে উঠতে হবে। আর এটা করার জন্য কোনও খরচও করতে হবে না, বা খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। আপনার ভেতরে যদি কোনও রকমের জড়তা বা লজ্জা থাকে – অনুশীলনের মাধ্যমে তাকে আপনি জয় করতে পারেন।
নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হোন, তাদের সাথে কথা বলুন। রাস্তায় কারও পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে তার সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করুন, ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে সামনের মানুষটির সাথে কথা বলুন। ব্যাংকিং ব্যবস্থা, বা আজকের সংবাদের শিরোনাম নিয়ে কথা বলুন।
হয়তো সবাই আপনার সাথে কথা বলবে না, এড়িয়ে যাবে।তা যাক; আপনার উদ্দেশ্য হবে নিজে এগিয়ে গিয়ে মানুষের সাথে কথা বলার অভ্যাস করা। অপরিচিতদের সাথে আলাপ করার অভ্যাস করা। ধীরে ধীরে দেখবেন আপনি কথা বলায় ও সম্পর্ক গড়ায় দক্ষ হয়ে উঠছেন।
অবশ্য অনেক সময়ে এমন হতে পারে যে, আপনি বলার মত কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে মানুষটিকে ভালোমত লক্ষ্য করুন। লক্ষ্য করুন: তার হাতে কি আছে? সে কোনদিকে তাকাচ্ছে? তার হাতে কোনও বিশেষ ব্র্যান্ডের ফোন দেখলে বলুন আপনিও এটি কিনতে চাচ্ছেন, এটার পারফর্মেন্স কেমন? – আবহাওয়া নিয়ে কথা বলুন। সে যদি আপনার সাথে কথা বলতে না চায়, অথবা তার যদি মুড না থাকে – তাহলে ভদ্রভাবে সরে আসুন। মনে রাখুন আপনি এটা করছেন নিজের জড়তা কাটানোর জন্য। কখন কথা বন্ধ করতে হবে, এটা জানাও কিন্তু কমিউনিকেশন স্কিলের একটি অংশ।
একজন মানুষের কাছে নিজেকে বিশ্বস্ত ও পছন্দনীয় করে তোলার জন্য হাসি মুখে মিষ্টি ভাষায় কথা বলা খুব জরুরী। অনেকেই এই কাজটি করতে পারেন না। প্রয়োজন হলে এই গুণ অর্জনের জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রাকটিস করুন। শুধুমাত্র মুখের হাসি আর মিষ্টি ভাষা দিয়ে একজন মানুষের মন কয়েক মূহুর্তেই জয় করে নেয়া যায়।
এর বাইরেও বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে যোগাযোগের দক্ষতাকে বাড়িয়ে নিতে পারেন। এছাড়া কিভাবে মানুষের সাথে কথা বলবেন ও সম্পর্ক তৈরী করবেন – এই বিষয়ে ইন্টারনেটে অনেক ভালো ভালো টিপস পাবেন। কাজেই ইচ্ছা থাকলে এটা রপ্ত করা কোনও ব্যপারই নয়।
০৬. নিজের সমালোচনা করতে শিখুন:
মানুষ ভুল করবেই। ভুল না করা মানুষ পৃথিবীতে একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভুলের উর্ধ্বে মানুষ তখনই উঠতে পারে যখন সে নিজের ভুল বুঝে সেই ভুল থেকে শিখতে পারে।
আপনি যদি সফল উদ্যোক্তা হওয়ার উপায় এর খোঁজে থাকেন, তাহলে নিশ্চই আপনার মাঝে একটি স্বাধীনচেতা মন রয়েছে। এই স্বাধীনচেতা মনটির কিন্তু একটি সমস্যা আছে। সে শুধু নিজের ইচ্ছাতে চলতে চায়। নিজের কাছে যেটা ভালো মনে হয় – সে সেটাই করতে চায়। নতুন কিছু করার জন্য এই মানসিকতা খুবই দরকারী। নাহলে আপনি অন্যের সমালোচনার কারণে থেমে যেতে পারেন। কিন্তু এই মানসিকতা যেন আপনাকে নিজের ভুল দেখা থেকে বিরত না করে।
একজন উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসায় নামার আগে নিজের ভুল ধরায় দক্ষ হওয়াটা খুব জরুরী। সেইসাথে আপনাকে নিজের ভুলগুলো স্বীকার করা শিখতে হবে। প্রথম অবস্থায় যে কোনও কিছু করতে গেলে ভুল হতেই পারে। আর সেগুলোকে স্বীকার করে নিতে হবে, নাহলে বিপদে পড়বেন।
ভুল স্বীকার না করলে সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেয়া বা সেই ভুল ঠিক করা যায় না। তাই নিজের সমালোচনা করতে শিখুন। তাহলে আপনার উন্নতি সব সময়েই অব্যহত থাকবে।
একজন মানুষের ইগো হতে পারে তার সবচেয়ে বড় শত্রু। এই ইগোর কারনে মানুষ নিজের ভুল দেখতে পায় না। আবার দেখতে পেলেও স্বীকার করতে চায় না। খুব ভালো করে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখুন আপনার মাঝে ইগোর কোনও অস্তিত্ব আছে কিনা। যদি থাকে, তবে একে দূর করার চেষ্টা করুন।
ইগোর কারনে আপনি নিজের সমালোচনা করতে পারবেন না, আর সেই সাথে অন্যদের গঠনমূলক সমালোচনাও ভালভাবে নিতে পারবেন না। ইগোর কারণে টিমের মানুষেরাও আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে। এটা উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কাজেই নিজেকে পারফেক্ট না ভেবে, পারফেক্ট মানুষ হওয়ার জন্য সব সময়ে চেষ্টা করুন। ব্যবসা শুরুর আগে, এমনকি একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার পরও এই চর্চা চালিয়ে যান।
০৭. বড় ভাবনা ভাবুন ও তা বিশ্বাস করুন
“মানুষ তার চিন্তার সমান বড়” – এটি একটি দারুন প্রচলিত উক্তি। এবং যুগে যুগে সফল মানুষেরা এই উক্তিকে সত্যি প্রমাণ করেছেন, এবং এখনও করছেন।
নেপোলিয়ন হিল তাঁর Think and Grow Rich বইয়ে ব্যাখ্যা করেছেন যে, মানুষ যে চিন্তায় দিন রাত কাটায়, যে চিন্তা তার অবচেতনে সবচেয়ে বেশি জায়গা নিয়ে থাকে – তার জীবনটা আসলে তেমনই হয়। কেউ যদি সব সময়ে চিন্তা করে যে সে ব্যর্থ হবে, তবে যত ভালো অবস্থাতেই সে থাকুক না কেন – সে ব্যর্থ হবে। কারণ, তখন ছোটখাট কোনও বাধার মুখে পড়লেও সে হাল ছেড়ে দেবে। আর যে বিশ্বাস করে যে সে সফল হবে, সে শত বাধা আর ব্যর্থতার মুখেও চেষ্টা করে যায়। এবং এক সময়ে গিয়ে সফল হয়।
একদম বাজে অবস্থায় থেকেও যদি মনে মনে বিশ্বাস করেন যে আপনি একদিন বিরাট কিছু করবেন – তাহলে যত বাজে অবস্থায়ই শুরু করেন না কেন, আপনাকে দিয়ে তা সম্ভব। একটি চিন্তা বারবার করতে করতে যখন তা বিশ্বাসে রূপ নেয়, তখন তা মানুষকে এক অন্যরকম আত্মবিশ্বাস দান করে। স্বপ্ন যত বিশালই হোক না কেন, যদি সত্যি সত্যি মনের ভেতর বিশ্বাস আনতে পারেন যে আপনি তা পূরণ করতে পারবেন, তবে তা বাস্তবে পরিনত হওয়াটা শুধুই সময়ের ব্যাপার।
নেপলিয়ন হিল বলেন, যদি কেউ প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য তার স্বপ্নের ভবিষ্যৎকে কল্পনা করে; এবং মনে মনে বলে যে, “আমার এই স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে/ আমি ‘অমুক দিন’ এই স্বপ্ন পূরণ করবো” – তাহলে মনে এক অজেয় বিশ্বাসের জন্ম নেবে। নিজে নিজেই একটা সময়ে বুঝবেন যে আপনি কাজটি করতে পারবেন। তাই স্বপ্ন যত বড়ই হোক, বিশ্বাস করুন যে আপনি তা পূরণ করতে পারবেন। কাজে নামার আগে বিশ্বাস করতে শিখুন যে সেই কাজ আপনার দ্বারা সম্ভব – তাহলে যে কোনও বড় স্বপ্ন দেখতে আর তা পূরণে কাজ করতে ভয় করবে না। কোনওকিছু না পারলে শিখে নিয়ে আবার শুরু করবেন, বার বার পড়ে গিয়েও বিশ্বাসের জোরে উঠে দাঁড়াতে পারবেন। আর বার বার উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই আপনি এক সময়ে সফল হবেন। জীবনে বড় কিছু করার গোপন উপায় আসলে এটিই।
০৮. ব্যবসায়ের মূল বিষয় গুলো সম্পর্কে জানুন
যে ব্যবসাই করেন না কেন, আপনাকে হিসাবরক্ষণ (accounting), ব্যাংকিং, মার্কেটিং, ট্যাক্স, ব্যবসায়িক ও মুদ্রা আইন সম্পর্কে জানতে হবে।
আপনি হয়তো রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করতে চান, এবং খাবারের বিষয়টা খুব ভালোকরে জানেন। সেটা অবশ্যই জানতে হবে। কিন্তু ভালোভাবে ব্যবসা করতে হলে আপনাকে হিসাবের ব্যাপারেও পাকা হতে হবে। ব্যাপারটা এমন নয় যে আপনাকে হিসাববিজ্ঞান বা ফাইন্যান্সে ডিগ্রী নিতে হবে – কিন্তু টাকার হিসাব কিভাবে ঠিকমত রাখতে হয়, লাভ ক্ষতি কিভাবে বের করতে হয়, ইত্যাদি ব্যাপারে আইডিয়া থাকতে হবে।