
একজন সত্যিকার সফল উদ্যোক্তা তাঁর ব্যবসার উন্নয়নের পাশাপাশি নিজেকেও সব সময়ে উন্নত করার চেষ্টা করেন। সফল উদ্যোক্তা হওয়ার উপায় হিসেবে এর কোনও বিকল্প নেই।
সফল উদ্যোক্তা হতে পারা অবশ্যই দারুন, কিন্তু সেই পথে চ্যালেঞ্জও কম নয়।আর এই চ্যালেঞ্জ জয় করতে সব সময়ে নিজেকে উন্নত করার বিকল্প নেই । বেশিরভাগ সফল উদ্যোক্তা খুবই উৎসাহী ও আশাবাদী ধরনের মানুষ। সেই সাথে তাঁরা জানেন যে, ব্যবসার উন্নতি ঘটানোর পাশাপাশি নিজের দক্ষতা ও জ্ঞানের উন্নতি করা কতটা দরকার।
পৃথিবীর সেরা উদ্যোক্তাদের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাঁরা সব সময়েই নিজেদের আপগ্রেড করার জন্য নতুন নতুন জ্ঞান ও দক্ষতা শেখার চেষ্টা করেন। প্রতিযোগীতায় টিঁকে থাকতে এবং ব্যবসাকে এগিয়ে নেয়ার এটাই সেরা উপায়। শুধু ব্যবসার পেছনে বিনিয়োগ করার বদলে যিনি ব্যবসাটি চালাচ্ছেন, তাঁর পেছনেও বিনিয়োগের দরকার আছে। উদ্যোক্তা নিজে যত উন্নত হবেন, তাঁর ব্যবসাও তত উন্নত হবে।
নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিমাপ করা, নিজের দুর্বল জায়গা গুলো খুঁজে বের করা, দুর্বলতাগুলো দূর করার জন্য নতুন কিছু শেখা – ইত্যাদি কাজ একজন সত্যিকার সফল উদ্যোক্তা সব সময়েই করতে থাকেন।
আর এগুলো তাঁরা সফল হওয়ার আগে থেকেই অভ্যাস করেন। আসলে সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আগেই কিছু বিশেষ গুন ও দক্ষতা অর্জন করা জরুরী। এমনই কয়েকটি টি গুণের কথা আজ আমরা আলোচনা করব।
০১. মাস্টার হতে হবে
আপনি যে ব্যবসাতেই নামেন না কেন, সেই ব্যবসার কোনও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনাকে মাস্টার হতে হবে। ধরুন আপনি টেক্সটাইল সেক্টরে ব্যবসা করতে চান। সেক্ষেত্রে আপনি টেক্সটাইলের যে বিষয়টিতে জোর দিতে চান, সেই বিষয়ে মাস্টার পর্যায়ের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
সেই বিষয়ে আপনাকে যেন কোনও দিক দিয়েই আটকানো না যায়। সেটা হতে পারে মেশিনারিজ সম্পর্কে, ফেব্রিক সম্পর্কে, ডাইং সম্পর্কে। এবং এই মাস্টারিটা যদি আপনি ব্যবসায় নামার আগে অর্জন করতে পারেন – তাহলে ব্যবসা করাটা আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে।
ইলন মাস্ক স্পেস এক্স চালু করার সময়ে তাঁর হাতে এত টাকা ছিল যে তিনি চাইলেই যে কোনও সময়ে অনেক বড় বড় রকেট বিজ্ঞানীকে মোটা বেতনে কাজে লাগিয়ে কোম্পানীর কাজ চালিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে আগে নিজে নিজে পড়াশুনা করে রকেট ও মহাকাশ বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করে তারপরই কাজে নেমেছেন।
সেরা পন্য বা সেবাটি সৃষ্টি করার জন্য সেই বিষয়ে অবশ্যই আপনার সেরা লেভেলের জ্ঞান ও দক্ষতা থাকতে হবে। সফল উদ্যোক্তা হওয়ার সহজ উপায় গুলোর মাঝে এটি অন্যতম।
আপনি যে ব্যবসাই করেন না কেন, তার ওপর আগে মাস্টারি অর্জন করুন। একটা পর্যায় পর্যন্ত জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন করে ব্যবসায় নামলে – এরপর অভিজ্ঞতা থেকে আরও দ্রুত শিখতে পারবেন।
প্রয়োজন হলে যে সেক্টরে কাজ করতে চান, সেই সেক্টরে চাকরি করুন। অভিজ্ঞদের কাছ থেকে শিখুন। কোর্সে ভর্তি হোন বা ইন্টারনেটে বা বই থেকে জ্ঞান নিন। উদ্যোক্তা হিসেবে দীর্ঘ মেয়াদে সফল হওয়ার জন্য এগুলো খুবই জরুরী।
০২. একটি বিষয়ে মাস্টার হলেও, জানতে হবে সবকিছুই
সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আপনার সেক্টরের একটি বিষয়ে মাস্টার হওয়া যেমন জরুরী, তেমনি খুঁটিনাটি সব বিষয়ের বেসিক ব্যাপারগুলো জানা থাকাটাও কম জরুরী নয়।
যদি আপনার কাজের ক্ষেত্রের সব বিষয়ে কিছু কিছু জ্ঞান আপনার না থাকে, তবে তা আপনার নতুন আইডিয়াগুলোকে নিয়ে কাজ করার সময়ে আত্মবিশ্বাস যোগাবে।
এছাড়াও নিজের ক্ষেত্রের বাইরেও যতটা পারা যায় জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এতে অনেক নতুন সুযোগকে কাজে লাগানোটা সহজ হয়ে যায়।নতুন কোনও সেক্টরে কাজ করতে গেলে আপনাকে একদম “অ-আ-ক-খ” লেভেল থেকে শুরু করতে হবে না – এবং বিষয়টি বোঝাও আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে।
একটা উদাহরণ দেয়া যাক; ধরুন আপনি টেক্সটাইল ব্যবসা করছেন। এখন কেমিক্যাল সেক্টরের একটি ভালো সুযোগের কথা আপনাকে কেউ বলল। এখন যদি আপনার কেমিক্যাল ইনডাস্ট্রি নিয়ে কিছুটা জ্ঞান থাকে – তবে আপনি সহজেই ব্যাপারটি বুঝতে পারবেন এবং সুযোগটি নিতে পারবেন। আর যদি একেবারেই কিছু না জেনে সেই ব্যবসায়ে নামেন, তবে সোজা বাংলায় ‘ধরা খাওয়ার’ সম্ভাবনা আছে।
আপনি হয়তো সব বিষয়ে মাস্টার হতে পারবেন না, কিন্তু সব বিষয়ের বেসিক ব্যাপারটা জেনে রাখতে পারবেন। এতে নিজের কাজ ও ব্যবসার ক্ষেত্রেও নতুন নতুন আইডিয়ার সমন্বয় ঘটাতে পারবেন – যা আপনাকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকতে সাহায্য করবে।
০৩. “হাতের মত করে” টিম গড়তে ও ম্যানেজ করতে শিখুন
প্রথম শুরু করার সময়ে আপনাকে বিশাল টিম নিয়ে কাজ করতে হবে না। হয়তোবা প্রথম পর্যায়ে একাই কাজ করবেন। তারপরও ব্যবসা শুরুর আগেই আপনাকে একটি ভালো টিম গড়া ও তা ম্যানেজ করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কোনও না কোনও সময়ে গিয়ে আপনাকে টিম চালাতেই হবে। একা বেশিদূর যাওয়া যায় না।
Quest Alliance এর সিইও আকাশ শেঠির মতে, একটি পারফেক্ট টিম হাতের পাঁচ আঙুলের মত। টিমের সবার একই রকম জ্ঞান ও দক্ষতা থাকলে তাকে কোনওভাবেই ভালো টিম বলা যাবে না।
হাতের পাঁচটি আঙুল সমান হলে কি আমরা এতটা ভালভাবে কাজ করতে পারতাম? সৃষ্টিকর্তা আমাদের হাতের পাঁচটি আঙুলকে আলাদা আকারে বানিয়েছেন, যাতে তাঁর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব অন্য জীবের তুলনায় বেশি দক্ষ ভাবে কাজ করতে পারে।
ভেবে দেখুন, একটি ফুটবল দলের ১১জনই পৃথিবীর সেরা স্ট্রাইকার। কিন্তু সেই দলে কোনও মিডফিল্ডার ও ডিফেন্ডার নেই। শুধু পৃথিবীর সেরা স্ট্রাইকারদের নিয়ে গড়া এই টিম কি কোনও ম্যাচ জিততে পারবে?
তেমনি একটি ভালো টিমেও সবার দক্ষতা ও জ্ঞান সমান হয় না। আলাদা আলাদা বিষয়ে দক্ষদের নিয়ে গড়া টিমই আপনাকে সেরা ফলাফল এনে দিতে পারবে। আর এই দক্ষ লোকগুলো কিভাবে চিনে নিতে হয়, কোন ধরনের মানসিকতার মানুষদের টিম গড়লে সবচেয়ে ভাল কাজ হবে – এসব বিষয়ে আপনাকে আগে থেকেই একটা ভালো আইডিয়া অর্জন করতে হবে।
এছাড়াও একটি টিমের সেরা পারফর্মেন্স বের করে আনার জন্য টিমের মাঝে কি ধরনের পরিবেশ বজায়ে রাখতে হবে, টিম মেম্বারদের কিভাবে ম্যানেজ করতে হবে – একজন উদ্যোক্তা হিসেবে এসবও আপনার জানা থাকা প্রয়োজন। একজন মানুষের সাথে অল্প সময় কাটিয়েই সে কেমন মানুষ – তা বোধার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। পড়াশুনা ও বিভিন্ন মানুষের সাথে মেশার মাধ্যমে মানুষ চেনার দক্ষতা বাড়াতে পারেন। কাকে দিয়ে কি কাজ হবে বা হবে না; কাকে বিশ্বাস করা যাবে, আর কাকে যাবে না – এসব বোঝার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। তাহলেই আপনি সফল ভাবে টিম বানাতে ও ম্যানেজ করতে পারবেন। টিম ম্যানেজ করার উপায় জানা থাকলে, সফল উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যাবে।
০৪. গায়ে কাদা লাগানো শিখতে হবে
ভারতের বাজারে সেরা অনলাইন শপ হলো Flipcart.com. বর্তমানে পুরো ভারতজুড়ে তাদের মাল্টি মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। শুরুতেএই শপের দুই উদ্যোক্তা বিনি বানসাল ও শচীন বানসাল নিজেরাই পন্য ডেলিভারী করতেন। ওয়েব সাইট চালানো থেকে শুরু করে ডেলিভারি ম্যানের কাজও তাঁরা করেছেন। এবং এভাবেই ধীরে ধীরে তাঁরা তাঁদের ব্যবসাকে গড়ে তুলেছেন।
আমাদের অনেকেই মাথায় ভালো ভালো আইডিয়া নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু তাদের অজুহাত: তারা লোকের অভাবে কাজ করতে পারে না। অনেকটা জনপ্রিয় বাংলা প্রবাদ “ধরি মাছ, না ছুঁই পানি” এর মত অবস্থা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মাছ ধরতে হলে আপনাকে হাতে কাদা লাগাতেই হবে। আজকের অনেক বড় বড় সফল উদ্যোক্তা এক সময়ে হকারের মত রাস্তায় রাস্তায় তাঁদের পন্য বিক্রী করেছেন। সফল উদ্যোক্তা হওয়ার একটি প্রধান উপায় হলো, সব ধরনের অহেতুক লজ্জা ঝেড়ে ফেলে শুধু লক্ষ্যের দিকে ফোকাস রাখতে হবে।
সফল উদ্যোক্তা হতে হলে কোনও কাজকেই ছোট ভাবতে পারবেন না। প্রথম দিকে সব কাজেই হাত লাগাতে হবে। আপনাকে একজন ভালো রিসার্চার থেকে শুরু করে একজন ভালো কাস্টোমার ম্যানেজার হতে হবে, প্রয়োজনে একজন ভালো ডেলিভারী ম্যান, এমনকি ঝাড়ুদারও হতে হবে। ব্যবসার প্রয়োজনে আপনাকে সবই করতে হবে। সফল উদ্যোক্তা হওয়ার আর কোনও বিকল্প উপায় নেই।
এবং সবচেয়ে জরুরী বিষয়, ব্যবসায় নামার আগেই এই অভ্যাসটি আপনাকে করে নিতে হবে, যাতে ব্যবসা শুরুর পর এগুলো করতে আপনার মাঝে কোনও প্রকার অনীহা না আসে। “নাচতে নেমে ঘোমটা দেয়া” যাবে না।