বিশেষ: লীলা মজুমদারের দৃষ্টিতে রবি ঠাকুর কেমন ছিলেন? জেনেনিন তাদের স্মৃতিকথা

একসময় কলকাতায় যেমন বিখ্যাত ছিল ঠাকুরবাড়ি, তেমনি গুণী পরিবার ছিল রায় পরিবার। রবীন্দ্রনাথ নিজেই এই পরিবারের সদস্যদের গুণগ্রাহী ছিলেন। কারণ বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে রায় পরিবার নিজেদের প্রতিভার জোরে আপামর বাঙালিকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায় এবং সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গেও সরাসরি যোগাযোগ ছিল রবীন্দ্রনাথের। উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে রীতিমতো সখ্য ছিল তার। রায় পরিবারের মেয়ে লীলা, পরে যিনি পরিচিত হবেন শিশুসাহিত্যিক লীলা মজুমদার হিসেবে।
শৈশবের এক আশ্চর্য রূপকথা তৈরি হয়েছে লীলা মজুমদারের সাহিত্যে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লেখা পড়তেন। প্রবীণ অগ্রজ লেখক হিসেবে সেই সময়কার নবীন লেখক লীলা মজুমদারকে দেখেই চিনেছিলেন। বুঝেছিলেন রায়বাড়ির ম্যাজিক কলমটি এই মেয়েটির কাছেও রয়েছে। তারপর স্নেহ ও আশিসের ফুলে ভরাট কথার মালা যেন পরিয়েছেন নবীন লেখককে। তারপর?
আবছা আলোর ছায়াঘেরা এক নতুন পৃথিবীতে বসে, পকেট ভর্তি নুড়িপাথরের মতো শৈশবের ঐশ্বর্য নিয়ে লিখে চললেন লীলা মজুমদার।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছোট ভাই ছিলেন প্রমদারঞ্জন রায়। ১৯০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১০০ গড়পার রোডের বাড়িতে জন্ম হলো প্রমদারঞ্জন ও সুরমাদেবীর মেয়ে লীলার। অমন সাহিত্যিক পরিবারে জন্মেছিলেন, জীবনদর্শন ছিল সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা। শৈশব কেটেছে শিলং পাহাড়ে। পাহাড়ী পাকদণ্ডীর আনাচকানাচ থেকে যেন হাজির হতো লীলার আশ্চর্য নির্মল গল্পের চরিত্ররা। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করেছিলেন লীলা। বিএ এবং এমএ উভয় পরীক্ষাতেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। কিছুদিন অধ্যাপনা করেন, কিছুদিন আকাশবাণীতে প্রযোজনা করেন, ‘সন্দেশ’ (Sandesh) পত্রিকার সম্পাদনাও করেছেন। ডক্টর সুধীরকুমার মজুমদারকে বিয়ে করেছেন লীলা। রবীন্দ্র পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন লীলা মজুমদার। তার জীবনেও একসময় এসে পড়েছিল রবির আলো।

শিলং পাহাড়ে লীলা পড়তেন সাহেবি স্কুলে। ফলে প্রথমে বাংলাটা একেবারেই ভালো পারতেন না। রবীন্দ্রসাহিত্যের সঙ্গেও পরিচয় ছিল না তার। ছোটোবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সব পড়েছি, বাদে রবীন্দ্রনাথের বই’। রবীন্দ্রনাথের নাম প্রথম শোনা নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। লীলা মজুমদারের ছোটোবেলার বাড়ির সবচেয়ে উঁচু তাকে রাখা ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘খেয়া’ কাব্যগ্রন্থ। ছোট্ট লীলার একবার আচার খাওয়ার জন্য একটুকরো কাগজের দরকার ছিল। তাই বেশি সাতপাঁচ না ভেবে টুলের উপর দাঁড়িয়ে সেই বইয়ের মাঝখান থেকে পাতা ছিঁড়ে নিয়ে আচার রেখেছিলেন। এই নিয়ে বাড়িতে প্রবল বকাবকি হলো। বিপর্যয়ের মধ্যেই লীলা প্রথম জানলেন বইটির লেখক রবীন্দ্রনাথ।

প্রশান্তকুমার মহলানবীশের কণ্ঠে কিছু রবীন্দ্রকবিতার আবৃত্তি শুনেছিলেন ছোট্ট লীলা। কিন্তু বোধগম্য হয়নি বলেই ভালো লাগেনি সহজ সরল লীলার।

সাক্ষাৎ রবীন্দ্রদর্শন হলো শিলং পাহাড়েই। তখন অবশ্য কবিকে বেশ লেগেছিল। সেই দিনের স্মৃতিচারণ করেছিলেন লীলা মজুমদার, ‘‘রবীন্দ্রনাথ নিজে তার ‘পুরাতন ভৃত্য’ পড়ে শুনিয়েছিলেন। শুনে আমরা মুগ্ধ। এমন মজা করে মজার কবিতা কাউকে কখনো পড়তে শুনিনি। এমনি নির্বোধ ছিলাম তখন, যে ঐ কবিতার বেদনার দিকটাই বুঝিনি, তা কবিকে বুঝব কী করে!’’

লীলা মজুমদারের কাছে সেদিন রবি ঠাকুর এসেছিলেন কনভেন্ট স্কুলের চার্চে দেখা যিশুর মতো হয়ে। এরপর ডায়োসেশান স্কুলে লীলা মজুমদারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় পূর্ণিমাদেবীর। পূর্ণিমাদেবী ছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগ্নি, প্রমথ চৌধুরীর ভাইঝি এবং সুবীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর লীলা মজুমদারের মধ্যে এক অন্যতম সংযোগের সেতু ছিলেন পূর্ণিমাদেবী।

একবার রবীন্দ্রনাথ দার্জিলিং গিয়েছেন। লীলা মজুমদারও তখন দার্জিলিঙে মাসির বাড়ি রয়েছেন। তার মেসোর সঙ্গে তিনি গিয়েছেন রবি ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে। লীলা মজুমদারের ছিল এক অনাবিল শিশুদৃষ্টি। বিশ্বভুবনকে তিনি দেখতেন শৈশবের জড়িবোনা মন দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ সেদিন পরেছিলেন গরম জোব্বা, টুপি আর নীল শুঁড়তোলা জুতো।

শিশুসাহিত্যিক লীলা মজুমদারের নজরে পড়ল তার খুশি খুশি মুখ। এই দুই খুশি মনের বন্ধুত্ব হলো অচিরেই। তবে রবি ঠাকুরের উঁচু পাহাড় ভালো লাগত না বলে তাড়াতাড়ি ফিরে গেলেন। সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য মনকেমন করল লীলা মজুমদারের। রবীন্দ্রনাথের মনখারাপ হয়েছিল নিশ্চয়ই। সেই কারণেই রাজার চিঠির মতো লীলা মজুমদারের কাছে রবি ঠাকুরের চিঠি এল। রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখে জানালেন, তিনি লীলা মজুমদারের ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পগুলো পড়েন। তিনি শান্তিনিকেতনের শিশুবিভাগের দায়িত্ব একবছরের জন্য দিতে চাইলেন লীলা মজুমদারকে।

এই ডাক পেয়ে লীলা মজুমদার সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছলেন শান্তিনিকেতন। সেদিন উত্তরায়ণে চায়ের আসরে মত বদলালেন রবীন্দ্রনাথ। লীলা ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী শুনে তাকে দায়িত্ব দিলেন বিশ্বভারতীর স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজি পড়ানোর। টানা একবছর শান্তিনিকেতনে ছিলেন লীলা মজুমদার। সেইসময় পূর্ণিমাদেবীও যোগ দিলেন শান্তিনিকেতনে।

এই আনন্দের মুহূর্তগুলো নিয়ে লীলা মজুমদার লিখেছিলেন ‘এক বছরের গল্প’। এই সময় রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ছিলেন লীলা মজুমদার। উত্তরায়ণের আড্ডা, রবি ঠাকুরের লুচি সন্দেশের ভাগ পাওয়া, গুণী মানুষের সঙ্গে পরিচিতি, রবীন্দ্রনাথকে রান্না করে খাওয়ানোর মতো ঘটনার কথা অক্ষরের বাঁধনে বেঁধে রেখেছিলেন লীলা মজুমদার।

শান্তিনিকেতনে নটীর পূজা নৃত্যনাট্যে লীলা মজুমদার সেজেছিলেন ভিক্ষুণী উৎপলপর্ণা। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ লীলা মজুমদারকে গল্পের বই প্রকাশ করার কথা প্রথম বলেছিলেন।

এরপর লীলা মজুমদারের আর অধ্যাপনা করতে ভালো লাগলো না। মনে হলো, অন্য কোনো কাজ তার জন্য অপেক্ষা করছে। রবীন্দ্রনাথও তখন পারস্য সফরে। তাকে জানিয়ে শান্তিনিকেতন থেকে চলে গেলেন লীলা। রবীন্দ্রনাথ বাধা দিলেন না। চিঠি লিখে অনুমতি দিলেন, সম্মান জানালেন লীলার মতামতকে। সে চিঠির অক্ষরগুলোও সম্পদ।

৭ পৌষ, ১৯৩৯ সালের চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘প্রতিদিনের কাজের টানা-হেঁচড়া গোলমালের মধ্যে আমাদের আশ্রমের আসন অখণ্ড থাকে না। মলিনও হয়, দুঃখও পাই। কিন্তু সেই কাজের বাইরে তুমি যে আসন পেয়েছ সে রইল তোমারি চিরকালের জন্যে। তোমার যখন অবকাশ, যখন খুশি, যদি আসো, দেখবে তোমার জন্য রয়েছে তোমার যথার্থ স্থান।’

শান্তিনিকেতনকে সত্যি ভালবেসেছিলেন লীলা। অনেক বছর পর ১৯৫৩ সালে শান্তিনিকেতনে বাড়িও করেছিলেন।

বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিলেন লীলা মজুমদার। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এসেছিলেন নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করতে। সেদিন কলকাতায় প্রবল বর্ষণ, হাঁটুজল! তবু এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিজের হাতে তৈরি একটি চামড়ার হ্যান্ডব্যাগ উপহার দিয়েছিলেন।

লীলা মজুমদার ও ডক্টর সুধীরকুমার মজুমদারের বিয়ে ছিল নিজেদের পছন্দের বিয়ে। পছন্দের মানুষকে বিয়ে করায় বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হলো লীলার। সারাজীবনের মতো সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন তার বাবা প্রমদারঞ্জন রায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এই বিয়েতে সমর্থন জানিয়েছিলেন।

লীলা মজুমদার নিজের ছেলের নাম রেখেছিলেন রঞ্জন। একবার চন্দননগরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লীলা মজুমদারের দেখা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ মজা করে বলেছিলেন, ‘আমাকে নাম রাখতে বললে না?’ তারপর নিজেই প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, ‘অবশ্য নাম তো আমার বইয়েই আছে।’

রথীন্দ্রনাথ প্রতিমাদেবীর মেয়ে পুপের বিয়েতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হয়েছিল লীলা মজুমদারের। তখন তার গল্পের বইগুলো প্রকাশিত হচ্ছে। শেষ দেখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুশয্যায়। এরপর ১৯৬১ সালে আকাশবাণীতে রবীন্দ্রশতবর্ষের অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন লীলা। ‘এই যা দেখা’ এবং ‘কবিকথা’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬১-তে। রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা নিয়ে ‘জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি’ নামে একটি বইও প্রকাশ করেছিলেন। ‘কবিকথা’ এবং ‘জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি’-র ইংরেজি অনুবাদও হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথের স্নেহ ও আশীর্বাদ লীলা মজুমদারের সঙ্গে ছিল। রবীন্দ্রনাথ চিনতে পেরেছিলেন ভবিষ্যতের শক্তিশালী শিশু সাহিত্যিককে। তাই রায়বাড়ির মেয়েটির সেই ম্যাজিক কলম জন্ম দেবে আশ্চর্য সব মজাদার চরিত্রের। তার গল্পের পাকদণ্ডীতে টুপ করে ঝরে পড়বে জীবনদর্শন। হাসি ও কান্নার মেলবন্ধনে তৈরি হবে আধুনিক রূপকথা। শিশু মনে রঙিন প্রজাপতি ডানা ঝাপটাবে আর তার পাখায় পাখায় লেখা থাকবে লীলা মজুমদারের জাদুকরী অক্ষর।

সহায়ক প্রবন্ধঃ
রবীন্দ্রনাথ ও রায় পরিবার, প্রসাদরঞ্জন রায়

Related Posts

© 2024 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy