ইউক্রেনে রাশিয়ার আকস্মিক আক্রমণ বিশ্ব রাজনীতিতে বেশ পরিবর্তন এনেছে। মস্কোর ওপর বিভিন্ন দেশের নেতিবাচক অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে, এই যুদ্ধের কারণ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্র দেশগুলো রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
তবে পশ্চিমা দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও মস্কোর বিরুদ্ধে নিন্দা জানাতে অস্বীকার করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার তেলের দাম কমে গেলে বিশেষ মূল্য ছাড়ে দেশটি থেকে তেল কিনেছে নয়াদিল্লি।
ভারতের এমন পদক্ষেপে হোয়াইট হাউজও নিজেদের অসন্তুষ্টির বিষয়টি চাপিয়ে রাখতে পারেনি। মস্কোর বিরুদ্ধে দিল্লির অবস্থান ‘কিছুটা নড়বড়ে’ বলে সমালোচনা হয়েছে।
কিন্তু চলতি মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাক্ষাতের পর হঠাৎ করেই পশ্চিমাদের সুর বদলে গেছে। দুজনের বৈঠকের পর ‘উভয় দেশের জনগণের মধ্যে গভীর সম্পর্ক’ ও ‘মূল্যবোধ ভাগাভাগি’ করার কথা উল্লেখ করেন মোদী এবং বাইডেন।
এসবের মধ্যেই গত শুক্রবার উভয় দেশের বাণিজ্য নিয়ে নিয়ে কথা বলতে দিল্লি পৌঁছান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। আর এসব কিছু তখনই ঘটতে দেখা গেল যখন রাশিয়া নিয়ে ‘মতপার্থক্য স্পষ্ট’ হয়ে উঠেছে।
তবে ইউক্রেন ইস্যুতে ভারত কিন্তু নিজেদের অবস্থান বদলায়নি। বরং শুরু থেকেই তারা একই অবস্থানে আছে। শুধু তাই নয়, এখনও রাশিয়ার কাছ থেকে কম দামে তেল কিনে যাচ্ছে নয়াদিল্লি।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে ভারত যে পরিমাণ তেল কিনেছে, ২০২২ সালের প্রথম কয়েক মাসেই তারা মস্কো থেকে সে পরিমাণ তেল কিনে ফেলেছে। এছাড়া মস্কোর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এখনও তারা নিশ্চুপই রয়েছে।
গত ৭ এপ্রিল রাশিয়াকে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে যে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়েছে সেখানেও ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল ভারত।
বিশ্লেষকরা এ বিষয়ে বলছেন, ভারত আসলে পশ্চিমা দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক কূটনীতির বিষয়ে ‘মাস্টারক্লাস’ করিয়ে দিয়েছে।
মূলত বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের উত্থান ঠেকাতে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ্ব শান্তির জন্য রাশিয়ার চেয়ে চীনকেই বড় হুমকি বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। তাই চীনের কণ্ঠরোধ করাটাই পশ্চিমাদের কাছে বেশি জরুরি।
লন্ডনের কিংস কলেজের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক হর্ষ ভি. পান্ত বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে সহযোগিতার ক্ষেত্রে তার ভারতকে একটি নতুন অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারত কেন গুরুত্বপূর্ণ?
স্থল ও সমুদ্রে বিভিন্ন অঞ্চল নিজেদের বলে দাবি করা, ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি এবং ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাবের কারণে দিল্লি এবং ওয়াশিংটন উভয়ের কাছেই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বেইজিং।
প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের শাসনামলে চীনের সামরিক বাহিনী পিপলস লিবারেশন আর্মি বিশ্বের বৃহত্তম নৌবাহিনীতে পরিণত হয়েছে। এছাড়া প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত চোরাগোপ্তা যুদ্ধবিমান এবং পারমাণবিক অস্ত্রের ক্রমবর্ধমান অস্ত্রাগার তৈরি করতেও সক্ষম হয়েছে তারা।
দিল্লিতে অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের প্রধান পান্ত বলেন, চীনকে দমিয়ে রাখতে ওয়াশিংটনের পরিকল্পনায় রয়েছে ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। এই দেশগুলো আবার কোয়াডের অন্তর্ভুক্ত। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে নৌ চলাচল ‘অবাধ ও স্বাধীন‘ রাখার উপায় খোঁজার যুক্তি দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত এ চার দেশ নিয়ে ‘কোয়াড’ গঠিত হয়। কোয়াডের এই চারটি সদস্য দেশের মধ্যে ২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে।
এদিকে প্রতিবেশী চীনকে নিয়ে ভারতের মধ্যেও যথেষ্ঠ উদ্বেগ রয়েছে। হিমালয় সীমান্তে উভয় দেশের মধ্যেই সামরিক অস্থিরতা বাড়ছে। কয়েক বছরের চলমান অস্থিরতায় বহু প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সীমান্তে সামরিক সরঞ্জাম বাড়াতে ভারত ব্যাপকভাবে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। বাইডেন এবং মোদীর বৈঠকে হয়তো এসব বিষয় নিয়ে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। সে কারণেই এখনও নয়াদিল্লি এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে।
সূত্র: সিএনএন