‘যেদিন ৩০ জনের বিছানাসঙ্গী হতে হতো, সেটা আমার জন্য ভালো দিন হিসেবেই ধরে নিতাম।’
৩০ বছরের স্যান্ড্রা এখনও শিউরে ওঠেন নিজের পুরোনো দিনের কথা ভাবলে। মেক্সিকোর ১৯ বছরের তরুণীকে অপহরণ করে নিয়ে আসা হয় আমেরিকায়। রাতারাতি তিনি হয়ে ওঠেন যৌনদাসী। তার ‘পিম্প’ অ্যালফ্রেডোর ইচ্ছানুসারে তাকে যেতে হত নানা জায়গায়। মেটাতে হত অসংখ্য পুরুষের খিদে।
পিম্প অর্থে মালিক। যার কাছে স্যান্ড্রা একজন ‘পোষ্য’ ছাড়া কিছু নন। ক্ষুধা কিংবা তৃষ্ণা পাক ‘কাজের’ সময় সেসবের কোনো সুযোগ নেই। এমনও দিন ছিল, ক্ষুধা-তৃষ্ণা চেপে রেখে টানা ১৬ ঘণ্টা ধরে ৮০ জন পর্যন্ত পুরুষের লালসার শিকার হতে হয়েছে স্যান্ড্রাকে! সামান্য প্রতিবাদেই চলত অকথ্য মারধর। জুটত না খাওয়াদাওয়া। শেষ পর্যন্ত কীভাবে তিনি পালিয়ে বেঁচেছিলেন, সে গল্পও কম রোমাঞ্চকর নয়। কিন্তু পালিয়ে এসেও স্যান্ড্রাকে প্রতি মুহূর্তে যুঝতে হয় নিজের অতীতের সঙ্গে। যে অতীত থেকে মুক্তি পাওয়া যে কত দুর্মর, প্রতি মুহূর্তে তা অনুভব করেন তিনি।
বেড়াতে গিয়ে প্রেম, তারপরই…
ইংল্যান্ড থেকে মায়ের সঙ্গে গ্রিসে বেড়াতে এসেছিল ১৪ বছরের মেগান স্টিফেন্স। আর তারপর রাতারাতি প্রেমে পড়ে গিয়েছিল এক তরুণের। ছোট্ট মেয়েটির পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না প্রেমিকের বেশে ওই তরুণ আসলে কে। প্রেমের ফাঁদে পা দিতে গিয়ে এক চোরাবালিতে তলিয়ে গিয়েছিল এই তরুণী।
কেমন ছিল যৌনদাসীর দিনগুলো? মেগানের কথায়, ‘সমস্ত পরিচয়কে যেন চুরি করে নেয়। যতদিনে আপনি বুঝতে পারবেন ক্ষতিটা ঠিক কত বড়, ততদিনে আর কিছু হারানোর বাকি থাকে না।’ স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেও এখনো কথা বলতে গেলে আর্তনাদের মতো হয়ে ওঠে তার কণ্ঠস্বর। অন্ধকার রাতে স্মৃতির ভেতরে ফণা তোলে হিসহিসে পৌরুষের গনগনে দাপট।
স্যান্ড্রা কিংবা মেগান। এমন রাশি রাশি নাম পাশাপাশি বসিয়েও এই তালিকা শেষ করা যাবে না। তাছাড়া কত নাম তো সামনেই আসে না। জাতিসংঘের হিসেব বলছে, বিশ্বজুড়ে যত মানুষ পাচার হয়, তাদের ৮০ শতাংশই আসলে যৌনদাসী হিসেবে পাচার হয়। অবশ্য কেবল যুবতী বা কিশোরী নয়। শিশু এমনকি পুরুষদেরও ব্যবহার করা হয়!
যৌন ব্যবসাকে যে পৃথিবীর ‘আদিমতম ব্যবসা’ বলা হয় একথা সকলেরই জানা। দেহব্যবসাকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া উচিত কি না এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ১০৯টি দেশে এই ব্যবসা বেআইনি। কিন্তু ৭৭টি দেশে সেই পেশাকেই আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আবার থাইল্যান্ডের মতো দেশে কার্যত মধ্যম পন্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু দেহব্যবসার বিষয়ে মতবিরোধ থাকলেও যৌনদাসী বিষয়ে সকলেই একমত। এই ঘৃণ্য শব্দটিকে যে পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে দেওয়া উচিত সেবিষয়ে সহমত সকলেই। এই নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই।
যৌন ব্যবসা কতটা পুরোনো
রোজমেরি রেগেলোর ‘এ শর্ট হিস্ট্রি অফ সেক্সুয়াল স্লেভারি’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, প্রাচীন গ্রিস ও রোমেও যৌনদাসীর প্রচলন ছিল। প্রথম থেকেই ‘মানবিকতা’ নামের শব্দটিকে দলে মুচড়ে তৈরি হয়েছিল ‘যৌনদাসী’ নামের শব্দটি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় প্রাচীন রোমের ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনটির কথা। যেখানে পরিষ্কার বলা হয়েছিল, কোনও ক্রীতদাসীকে যদি তার প্রভু ধর্ষণ করে, তবে তা আইনত কোনো অপরাধ হতেই পারে না! অর্থাৎ রাষ্ট্রই কার্যত স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছিল পুরো বিষয়টিকে।
পরবর্তী সময়ে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আফ্রিকার মানুষদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু কেবলই ভৃত্য, কৃষিকাজ কিংবা শ্রমিক হিসেবেই তাদের ‘ব্যবহার’ করা হত তা নয়। পুরুষদের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করা হত নারীদের। কারণ সহজেই বোধগম্য। সেই ক্রীতদাসীকে আসলে যৌনদাসী হয়ে প্রভুর ‘সেবা’ করতে হত। মুখ বুজে সইতে হত নিরন্তর অত্যাচার।
ইতিহাস এভাবেই পদে পদে বুনে রেখেছে লজ্জার জলছাপ। তবে যৌনদাসীদের কথা বলতে বসলে আলাদা করে বলতেই হয় জাপানের ‘কমফোর্ট উওমেন’-দের কথা। নাম থেকেই সবটা পরিষ্কার হয়ে যায়। জাপানি সেনাকে তুষ্ট ও তৃপ্ত করতে কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস বা জাপানেরই হতভাগ্য মেয়েদের ধরে এনে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হত। অন্তত ২ লাখ নারীকে সেনাদের ‘বিনোদনে’র কাজে ব্যবহার হিসেব মিলেছে। সেই হিসেবে এটি বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম বৃহৎ মানব পাচারের ঘটনা।
তবে অনেক সময় চূড়ান্ত অসহায়তার মধ্যেই জেগে ওঠে প্রতিরোধেরও আগুন। আইসিস জঙ্গিনেতা আবু আনাসকে গুলি করে হত্যা করেন তারই এক যৌনদাসী। ইরাকের মসুলে আবু আনাস নামের ওই জঙ্গিকে মেরে তার উপরে হওয়া ঘৃণ্য অত্যাচারের প্রতিশোধ নিয়েছেন তিনি। কিন্তু এমন উদাহরণ খুব বেশি নেই। আসলে দিনের পরদিন ধরে চলতে থাকা ভয়ংকর অত্যাচার যেন মেরুদণ্ডটাই ভেঙে দিতে চায়। তবুও প্রতিরোধের শেষ শক্তিটুকু উজাড় করে বেরিয়ে আসতে চান তারা।
শেষ করার সময় তাই নাদিয়া মুরাদের কথা। যৌনদাসী থেকে নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী হয়ে ওঠার রূপকথার কাহিনি যেন নরক থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে এক চূড়ান্ত নিদর্শন হয়ে গেছে। ‘দ্য লাস্ট গার্ল’ বইয়ে তিনি বর্ণনা দিয়েছেন কীভাবে ২০১৪ সালে আইসিস জঙ্গিরা তার ছয় ভাই-সহ গ্রামের পুরুষদের খুন করে সব নারীকে অপহরণ করে। পরে নাদিয়াকে যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। কেনার জন্য পছন্দ করার প্রতীক হিসেবে পেটে দেওয়া হয় জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা! পরবর্তী সময়ে কোন ভয়ংকর দিন অপেক্ষা করে রয়েছে, ওইটুকুতেই ছিল তার তীব্র ইঙ্গিত।
ইয়াজিদি এই নারী হার মানেননি। পালাবার চেষ্টা করে গণধর্ষিত হয়েছেন। তবু শেষ পর্যন্ত পালিয়ে আসতে পেরেছেন। যদিও ফিরে এসে দেখেছিলেন, তার এতদিনের চিরচেনা গ্রামটাই আর নেই! সব এখন ধ্বংসস্তূপ। এরপর তিনি নিজেই তিলে তিলে নিজের জন্য গড়ে নিয়েছেন এক নতুন ভুবন। খুঁজে নিয়েছেন বেঁচে থাকার মানে। নাদিয়ার প্রত্যাবর্তন বুঝিয়ে দেয়, যৌনদাসীর ইতিহাস হাজার হাজার বছরের পুরোনো হতে পারে। একলা নারীর রুখে দাঁড়ানোর, খাদের ধার থেকে ফিরে আসা গল্পও ইতিহাসের পাতায় এক দীর্ঘ অনতিক্রম্য অধ্যায়ের অংশ।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ উপন্যাসের সেই চিরকালীন সংলাপ মনে পড়ে। ‘এ ম্যান ক্যান বি ডেস্ট্রয়েড বাট নট ডিফিটেড’। মানুষ ধ্বংস হতে পারে, হার মানতে পারে না। অসহায় এই সব মানুষদের ফিরে আসার গল্প যেন সেই কথাকে নতুন করে সত্যি বলে প্রমাণ করে। প্রমাণ করে, ধ্বংসস্তূপের আগাছাতেও ফুল ফোটে। তারা সূর্যের আলোয় হেসে ওঠে অন্য যে কোনো ফুলের মতোই।