নেতা হওয়ার যোগ্যতা বলতে সাধারণ ভাবে বোঝায়, একজন মানুষের নিজের দর্শনকে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া এবং তাদের দিয়ে স্বেচ্ছায় কাজ করিয়ে নেয়ার গুণ।
সম্পূর্ণ নিজস্ব আইডিয়া বা দর্শন আছে এমন মানুষ পাওয়া এমনিতেই কঠিন। সেইসাথে যদি তার এমন যোগ্যতা থাকতে হয়, যার কারণে অন্যরাও নিজের মনে করে তার স্বপ্ন পূরণে কাজ করবে – তাহলে এমন মানুষ লাখে একজনও পাওয়া যায় না।
এই কারণেই রাজনীতি, ব্যবসা উদ্যোগ বা অন্য যে কোনও ক্ষেত্রেই নেতার সংখ্যা কম। আবার যাদের নেতা বলা হয়, তাদের বেশিরভাগেরই সত্যিকার নেতা হওয়ার যোগ্যতা নেই। কিন্তু একজন মানুষের পক্ষে নেতা হয়ে ওঠা কি আসলেই এত কঠিন?
এটা আসলে অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। যে মানুষটি নেতা হতে চাইছে, বা নিজেকে নেতা মনে করছে – অনেক সময়েই সে নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে সচেতন নয়। আবার এমন মানুষও আছে যার নেতা হওয়ার সবগুলো যোগ্যতাই আছে, কিন্তু সেগুলো সে ঠিকমত ব্যবহার করতে পারছে না।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, নেতা হওয়ার যোগ্যতা গুলো চাইলে চর্চার মাধ্যমে অর্জন করা যায়। নেতা হয়ে না জন্মেও নেতার গুণগুলো নিজের মাঝে আনা যায়।
আপনিও যদি সত্যিকার নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চান, অথবা সঠিক নেতা চিনে নিতে চান – তবে এই লেখাটি আপনার জন্য।
নেতা হওয়ার যোগ্যতা: একজন সত্যিকার নেতার ৯টি যোগ্যতা
০১. সততা
যে কোনও ক্ষেত্রে একজন সত্যিকার নেতা হতে হলে সততার গুণ থাকা আবশ্যক। এমনিতেই একজন সম্মানিত মানুষকে অবশ্যই সৎ হতে হবে। আর যদি সে একজন নেতা হয়, যার অধীনে কয়েকজন থেকে শুরু করে কয়েক লক্ষ মানুষ আছে – তাহলে সততার ক্ষেত্রে সে একটুও ছাড় দিতে পারবে না।
এমনকি অসৎ নেতারাও নিজের লোকের কাছে নিজেকে সৎ বলে জাহির করার চেষ্টা করে। কিন্তু একটা সময়ে গিয়ে সেই মুখোশ খুলে যায়, এবং তার দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। – এমন হাজার হাজার উদাহরণ পৃথিবীতে আছে।
মানুষ একজন খারাপ মানুষকেও অনুসরন করে – কিন্তু অসৎ ও নীতিহীন মানুষকে কেউ অনুসরন করে না। আপনি যে ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব দিতে চান না কেন, অথবা যে নেতাকেই অনুসরন করতে চান না কেন – অবশ্যই সততাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন।
কথা বলার আগে ভেবেচিন্তে বলবেন। কারণ একজন নেতার মুখের কথা ও কাজে যদি মিল না থাকে, অনুসারীরা তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
আরেকটা কথা মনে রাখবেন, মানুষ মাত্রই ভুল হয়। এবং ভুল স্বীকার করার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই। কোনও ভুল করলে অনুসারীদের কাছে তা স্বীকার করুন। অন্যের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করবেন না, বা অজুহাত দেয়ার চেষ্টা করবেন না। এতে মানুষ আপনার ওপর থেকে শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলবে। সততার সবচেয়ে বড় একটি প্রমাণই হল নিজের দোষ স্বীকার করতে পারা।
আপনি সৎ না থাকলে যেমন মানুষ আপনার ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তেমনি অসৎ মানুষকে অনুসরন করলে একটা সময়ে গিয়ে ঠকতে হবে। সততার বিষয়ে যে আপোস করে, সে কখনওই একজন যোগ্য নেতা হতে পারে না।
০২. অন্যদের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারা
একজন নেতার নিজস্ব আইডিয়া ও দর্শন থাকবে – এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একজন নেতাকে তার কর্মীদের ওপর বিশ্বাস রাখা শিখতে হবে। সবকিছু নিজে করতে গেলে, বা সব কাজ সব সময়ে নিজে তদারক করতে গেলে নিজের মূল কাজে আপনি মনোযোগ দিতে পারবেন না।
একজন নেতাকে তার প্রতিটি কাজের জন্য যোগ্য লোক বেছে নেয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে। সেইসাথে, তাদের ওপর বিশ্বাস রাখার কক্ষমতা থাকতে হবে। যে অন্যের ওপর বিশ্বাস করতে পারে না, বুঝতে হবে তার আসলে নিজের বিচার বিবেচনার ওপর বিশ্বাস নেই। নিজের বিবেচনার ওপর বিশ্বাস না থাকলে তাকে কোনওভাবেই নেতা বলা যাবে না।
০৩. যোগযাযোগ দক্ষতা
একজন মানুষ যদি চায় অন্যরা তাকে অনুসরন করুন, স্বেছায় তার হয়ে কাজ করুক – তবে অবশ্যই তাকে মানুষের সম্পর্ক করার এবং নিজের কথাগুলো তাদের ভালোমত বোঝানোর যোগ্যতা থাকতে হবে।
আপনি যে ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব দিতে চান না কেন, আপনাকে অবশ্যই অন্যদের সাথে যোগাযোগে দক্ষ হতে হবে। অকপটে মানুষের সামনে কথা বলার সাহস ও বন্ধু বানানোর দক্ষতা থাকতে হবে।
মানুষ তখনই আপনাকে নেতা হিসেবে মেনে নেবে, যখন তারা আপনাকে বিশ্বাস করবে, ভালোবাসবে, এবং বুঝতে পারবে যে, আপনার আইডিয়া তাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে। পৃথিবীর প্রায় সব বড় নেতাই ভালো বক্তা, কারণ, নেতা হওয়ার জন্য নিজের কথার মাধ্যমে অন্যদের অনুপ্রাণিত করা একটি প্রয়োজনীয় গুণ। কাজেই মানুষের কথা ও আবেগ বোঝার বোঝার, এবং নিজের আইডিয়া তাদের বোঝানোর ক্ষমতা নেতা হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বড় যোগ্যতা।
০৪. সহজ হতে পারা
বস এবং লিডারের মধ্যে একটি মূল পার্থক্য হল, বস চাইলে সব সময়ে গম্ভীর ভাব নিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু একজন সত্যিকারের নেতাকে সহজ হতে হবে। যে মানুষ সব সময়ে গম্ভীর হয়ে থাকে, এবং অন্যরা যার কাছে আসতে ভয় পায় বা দ্বিধাবোধ করে – সে আর যাই হোক, নেতা নয়।
যদি একটি বড় কাজ ছুটে যায়, যদি কোনও টেকনিক্যাল ঝামেলা হয়, বা অন্য কোনও বড় বিপদ আসে – একজন নেতা প্রথমেই ধমকা ধমকি করে পরিবেশ আরও খারাপ করবে না। সে বোঝার চেষ্টা করবে আসলে কি হয়েছে, এবং এর সমাধান কি হতে পারে।
নেতার আচরণ এমন হবে যে প্রয়োজনে প্রাণ খুলে হাসতে পারে, এবং প্রয়োজনে কঠোর হতে পারে। তাকে এমন হতে হবে, যেন তার অনুসারীরা নির্ভয়ে তাদের চিন্তা ও আইডিয়ার কথা তাকে বলতে পারে। তার কাছে এসে নার্ভাস বা ভীত হওয়ার বদলে যেন তারা ভরসা পায়।
০৫. আত্মবিশ্বাস ও সাহস
একজন মানুষের সাহস আর আত্মবিশ্বাস অন্যদের যেভাবে কাছে টানে, তার অন্য কোনও গুণই অন্যদের এতটা কাছে টানতে পারে না। অন্যরা যেখানে পথের শেষ বা শুধুই বিপদ দেখবে – একজন নেতা সেখানেই নতুন সম্ভাবনা ও সুযোগ দেখতে পাবে।
আত্মবিশ্বাস ভাইরাসের মত। নেতার মাঝে যদি সত্যিকার আত্মবিশ্বাস থাকে, তবে তা অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে যায়। নেতার কাছে যদি কোনও অসম্ভবকে সম্ভব মনে হয়, তবে তার অনুসারীরাও তা বিশ্বাস করতে শুরু করে।
অনেক সময়েই এমন হয় যে, কেউ সামনে এগুতে সাহস পাচ্ছে না, শুধু মাত্র একজন মানুষই প্রথম পা বাড়ায়। এবং তার প্রাথমিক সাফল্যের পর অন্যরা তাকে অনুসরন করতে শুরু করে।
এই প্রথম পদক্ষেপ যে নেয়, সেই আসলে নেতা। এবং প্রথম পদক্ষেপটি নেয়ার জন্য প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস ও অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ানোর সাহস। এটা যারা করতে পারে, অন্যরা তাদের এমনিতেই নেতা বলে মেনে নেয়।
০৬. উদাহরণ সৃষ্টি করা
আপনি যদি চান আপনার টিম কঠোর পরিশ্রম করে তাদের সেরা কাজটি উপহার দেবে, তবে সবার আগে আপনাকে তা করে দেখাতে হবে।
নেতাকে নিজের হাতে কাজ করে উদাহরন সৃষ্টি করতে দেখার চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আর কিছু হতে পারে না।
নেতা যদি তার নিজের কাজটি পূর্ণ ভাবে করেন, তাহলে অনুসারীরা ফাঁকি দিতে বা কাজে ঢিল দিতে লজ্জাবোধ করে। অন্যদিকে যে নেতা নিজের হাতে কাজ না করে শুধু অন্যদের নির্দেশ দিতে পছন্দ করে – তার অনুসারীরা তার প্রতি অতটা শ্রদ্ধাশীল হয়না, এবং কাজের প্রতি অতটা দায়িত্বশীলও হয় না। নেতা হিসেবে আপনি যদি উদাহরণ সৃষ্টি করতে চান, তবে সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলতার সাথে নিজের কাজ করুন। আপনার দেখাদেখি অন্যরাও তাদের কাজটি ঠিকমত করার জন্য উৎসাহিত হবে।
০৭. আশাবাদী হওয়া ও অন্যদের অনুপ্রাণিত করা
আত্মবিশ্বাসের মত আশাবাদী মনোভাবও মানুষের মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে যায়। কোনও কাজে ব্যর্থ হলে বা সাময়িক ভাবে বাধাগ্রস্থ হলে অন্য সবাই যদি হাল ছেড়ে দেয় – তবে নেতা হিসেবে আপনার দায়িত্ব হবে, হতাশার মাঝে সম্ভাবনা খুঁজে বের করা। এবং সেই স্বপ্নকে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া।
অন্যরা যখন কোনও আশা দেখবে না, তখনই আসলে নিজেকে নেতা হিসেবে প্রমাণ করার সবচেয়ে বড় সুযোগ। আপনি যখন হতাশার মাঝেও অন্যদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিতে পারবেন – তখন সবাই আপনার মাঝে ভরসা খোঁজার চেষ্টা করবে – যা আপনাকে নেতা হিসেবে আরও শক্তিশালী করে তুলবে।
০৮. সিদ্ধান্ত নেয়ার ও নতুন বিষয় শেখার দক্ষতা
একজন নেতার প্রধান কাজই হল সিদ্ধান্ত নিতে পারা। সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সবাই নেতার দিকেই তাকিয়ে থাকে।
অনেকেই সঠিক চিন্তা করতে পারে, তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে পারে – কিন্তু তারপরও সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ শুরু করতে পারে না। কারণ তাদের মাঝে সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আত্মবিশ্বাস ও সাহস থাকে না।
নেতা হিসেবে আপনাকে এই সাহসটিই দেখাতে হবে। সেইসাথে তথ্য ও পরিস্থিতিকে সঠিক ভাবে বিচার বিবেচনা করার মত জ্ঞান ও বুদ্ধি অর্জন করতে হবে। এর জন্য আপনাকে প্রতিনিয়ত নিজের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। আপনার কাজের ক্ষেত্রে যা যা শেখা সম্ভব – সবকিছুই শেখার চেষ্টা করতে হবে।
স্টিভ জবস অথবা ইলন মাস্ক বিশ্বসেরা উদ্যোক্তা হওয়ার পাশাপাশি নেতা হিসেবেও অসাধারণ। তাঁদের মূল শক্তির জায়গাই হল তাঁদের জ্ঞান আর শেখার ক্ষমতা। তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে তাঁরা বড় হতে পেরেছেন, কারণ তাঁরা সেইসব ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে বেশি জেনেছেন। এই জানাই আসলে মানুষের মাঝে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার আত্মবিশ্বাস ও বুদ্ধি সৃষ্টি করে।
প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শিখে নিজেকে আরও দক্ষ করে তোলা এবং সেই জ্ঞান ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারা সত্যিকার নেতা হওয়ার অন্যতম যোগ্যতা।
০৯. অন্যদের প্রতি যত্মশীল হওয়া
একজন মানুষ যদি শুধু নিজের ব্যাপারেই চিন্তা করে, এবং নিজের জন্যই কাজ করে – তবে সে আর যাই হোক – নেতা নয়। সত্যিকার নেতার অন্যতম যোগ্যতা হল সে তার অনুসারীদের প্রতি যত্নশীল। যে কোনও কাজে যেন তার নিজের পাশাপাশি অন্যরাও লাভবান হয় – সেই ব্যাপারে একজন সত্যিকার নেতা সব সময়ে সচেতন থাকেন।
নিজের জ্ঞান ও দক্ষতা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে একজন সত্যিকার নেতা আনন্দ পান। নিজের লোকদের সফল হতে দেখা নেতার জন্য অন্যতম প্রাপ্তি হওয়া উচিৎ। একজন নেতা যখন অনুসারীদের উন্নতিতে অবদান রাখেন, তখন নেতার জন্য কাজ করাকে তারা দায়িত্ব বলে মনে করে। এবং নেতার জন্য নিজের মন প্রাণ উজাড় করে দেয়।
পরিশিষ্ট:
নেতা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা একদিকে যেমন কঠিন, আবার সেটা সহজও। এর জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা এবং যোগ্য নেতা হওয়ার চর্চাকে ধরে রাখা। একজন নেতার পক্ষে বহু মানুষের জীবন বদলে দেয়ার পাশাপাশি পৃথিবীর ইতিহাসকেও বদলে দেয়া সম্ভব। যুগে যুগে বিভিন্ন ক্ষেত্রের মহান নেতারা এটা প্রমাণ করে গেছেন। এখন সময় আপনার।
আর সেই পথে নেতা হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে এই লেখাটি যদি আপনার একটুও উপকারে আসে, তাহলেই আমাদের উদ্দেশ্য সফল।