‘ভারী কাজের বোঝাই তরী কালের পারাবারে
পাড়ি দিতে গিয়ে কখন ডোবে আপন ভারে।
তার চেয়ে মোর এই ক-খানা হালকা কথার গান
হয়তো ভেসে বইবে স্রোতে তাই করে যাই দান।’
বুড়িগঙ্গার তীরকে ঘিরেই গড়ে ওঠে জমজমাট নগরী ঢাকা। নদীর তীরে ঘেঁষে গড়ে উঠা এই জনপদকে আরেকটু রাঙ্গিয়ে দিতে নানা ব্যবস্থাও ছিল। মোঘল সুবাদার থেকে কবি-সাহিত্যিক; অনেকেই এই নদীর প্রেমেই পড়ে গিয়েছিলেন। বাদ যাননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। তিনি বুড়িগঙ্গায় বসে লিখেছিলেন লিখেছিলেন উপরে উল্লিখিত চারটি চরণ।
১৮৮৮ থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যে অসংখ্যবার পূর্ববঙ্গে পা রাখেন রবি ঠাকুর। অগণিত দিন-রাত কাটিয়েছেন। পাবনার (বর্তমানের সিরাজগঞ্জ জেলা) শাহজাদপুর, নওগাঁর পতিসর, কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ছিল তাদের জমিদারির অঞ্চল। এই তিন কাছারিতে রবীন্দ্রনাথ এসেছেন অনেক বার।
তবে রবীন্দ্রনাথ তার জীবনে ঢাকায় এসেছেন দুবার। একবার ১৮৯৮ সালে, অন্যবার ১৯২৬ সালে। প্রথমবার ১৮৯৮ সালে (১৩০৫ বঙ্গাব্দ) তিনি ঢাকায় এসেছিলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের দশম অধিবেশনে যোগ দিতে। প্রথমবার তথা ১৮৯৮ সালে রবীন্দ্রনাথের ঢাকা আসা নিয়ে তেমন শোরগোল হয়নি। সেবার তিনি ঢাকায় ছিলেন তিন দিন। ৩০ মে থেকে পহেলা জুন পর্যন্ত এই তিন দিন তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে ইন্ডিয়ান রিলিফ সোসাইটির সভায় রবীন্দ্রনাথসহ ঠাকুর পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যকে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়েছিল। সেই প্রতিনিধি দলে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দাদা ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগদানকারী প্রথম ভারতীয়, লেখক সংগীতস্রষ্টা ও ভাষাবিদ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয়তাবাদী নেতা ব্যারিস্টার যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, প্রখ্যাত শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিশ্বকবির প্রথমবারের আগমন নিয়ে খুব একটা মাতামাতির খবর জানা যায়নি। তবে তার দ্বিতীয়বারের ঢাকা আগমন নিয়ে শুধু যে মাতামাতিই হয়েছে তা-ই নয়, ঢাকাবাসীর মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। তিনি কোথায় থাকবেন, কী খাবেন-এসব বিষয় নিয়ে শুরু হয়ে যায় দলাদলি। ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিকরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় আসার পর কারো বাসায় না উঠে বুড়িগঙ্গা নদীতে রাখা নৌযানে অবস্থান নেন। রমনা সবুজ চত্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু বাংলো থাকার পরও কবিগুরু কেন নদীর মধ্যে নির্জন পরিবেশকে বেছে নিয়েছিলেন এমন প্রশ্ন আজকাল অনেকেই করে থাকেন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন গবেষক নানা মত দিয়েছেন। তবে অধিকাংশের মতে, মূলত ঢাকাবাসীর দলাদলির হাত থেকে রক্ষা পেতে রবীন্দ্রনাথ নিজে থেকেই বুড়িগঙ্গার নৌযান বেছে নেন।
রবীন্দ্রনাথ প্রথমবারও বুড়িগঙ্গায় এসেছিলেন। সেবার সফরের দ্বিতীয় দিন বিক্রমপুরের ভাগ্যকূলের জমিদারদের সৌজন্যে বুড়িগঙ্গা নদীতে এক নৌ-ভ্রমণের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত হয়ে ভাগ্যকুলের ধনাঢ্য জমিদারদের আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন।
দ্বিতীয়বার রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় আসেন ৯ দিনের সফরে। এসময় শোরগোল পড়ে যায় গোটা শহরে। রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন গোয়ালন্দ, নারায়ণগঞ্জ হয়ে। রবীন্দ্রনাথের সেই সফরে থাকা-খাওয়া ঢাকার গণ্যমান্য সমাজে বিভক্তির দেখা দেয়। কারণ তখন তিনি প্রচণ্ড জনপ্রিয়। তাই মোটর শোভাযাত্রা গিয়ে পৌঁছে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে। রবীন্দ্রনাথ অবস্থান করেন বুড়িগঙ্গা নদীর ওয়াইজ ঘাটে নবাব সলিমুল্লাহ’র ছেলে খাজা হাবিবুল্লাহ’র বিলাসবহুল জলযান তুরাগ হাউস বোটে।
সফরে তুরাগ হাউস বোটে অবস্থানকালীন সময়ে প্রতিদিন সকালে রবীন্দ্রনাথ ঢাকার নবাবদের মোটর চালিত বোটে বুড়িগঙ্গায় ভ্রমণে বের হতেন। এসময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে থাকতো বই, কিছু কাগজ। প্রায় ছয় থেকে সাত মাইল ভ্রমণ করতো মোটরচালিত বোট।
বুড়িগঙ্গায় বেশ আয়েশের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বসবাস করেছিলেন। সেখানে তিনি অনেককে সাক্ষাৎও দিয়েছিলেন। সেখানে ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশিষ্ট মহিলারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করে তাকে অভ্যর্থনা জানান। তার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন ঢাকার বিপ্লবীদের কয়েকজন সদস্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এসব বিপ্লবী সশস্ত্র সংগ্রাম করতেন। রবীন্দ্রনাথের নিরাপত্তা কমিটির প্রধান ছিলেন সত্য গুপ্ত। তিনি পরে সুভাষ চন্দ্র বসুর সহযাত্রী হিসেবে মেজর সত্য গুপ্ত হিসেবে খ্যাতিমান হন।
বুড়িগঙ্গায় ভ্রমণের কথা তুরাগ হাউস বোটের স্বেচ্ছাসেবক স্নিগ্ধকুমার গুহের বিবরণেও জানা যায়। ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রত্যুষে কবিগুরু বুড়িগঙ্গায় জল-ভ্রমণে বেরোনোর সময় তিনি কবিগুরুর লেখা ‘বলাকা’ বইটি দিয়ে সেখানে তার একটি কবিতা লিখে দেওয়ার অনুরোধ করলে কবি বইটি হাতে নিয়ে বললেন-বইটি পড়ে নিও। ঘণ্টাখানেক কবিগুরু জল-ভ্রমণ করে এসে তার হাতে বইটি ফেরত দেন। স্নিগ্ধকুমার গুহ বইটি খুলে দেখেন, তাতে লেখা রয়েছে কবির স্বাক্ষর করা ওই চার লাইনের কবিতাটি (প্রথমে উল্লিখিত)।
একই দিন বুড়িগঙ্গায় কবিগুরুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক সুখরঞ্জন রায়। তিনি স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেন, ‘কবি থাকতেন বজরায়। বুড়িগঙ্গার বক্ষে বজরার ওপর তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। ডা. মজুমদার, ডা. ঘোষ, ব্যারিস্টার আর কে দাশ প্রভৃতি ঢাকার গণ্যমান্যদের অনেকে উপস্থিত ছিলেন সেখানে। কবির বয়স সম্বন্ধে আলাপ হচ্ছিল। তার বয়স তখন বোধ হয় চৌষট্টি ছিল। ডা. মজুমদার আমার পরিচয় করে দেন।’
১৯২৬ সালে ঢাকা সফরে রবীন্দ্রনাথের সফরসঙ্গী হিসেবে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছেলে রথীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রধান স্বরলিপিকার দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র সহযোগী কালীমোহন ঘোষ, ইতালির খ্যাতনামা অধ্যাপক জিয়োসেপ্নে তুচ্চি।
ঢাকায় রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা দিয়েছিল বেশ কয়েকটি সংগঠন, কবির সফরের সময় স্বল্পতা ছিল বলে অনেকে কবিকে পাওয়ার আবেদন করেও পায়নি। কবিকে প্রথম সংবর্ধনা দিয়েছিল ঢাকা পৌরসভা ও পিপলস অ্যাসোসিয়েশন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হয়েছিল নর্থ ব্রুক হলে। রবীন্দ্রনাথতে ঢাকার মানুষের পক্ষ থেকে মানপত্র দেওয়া হয়েছিল। ঢাকা মনমোহন প্রেসে ছাপা সেই মানপত্র অনুষ্ঠানে পাঠ করেছিলেন আর কে দাস।