নতুন অনুপ্রেরণা খুঁজে পাওয়া সাফল্যের পথে চলার অন্যতম উপাদান সাফল্য আসলে এক একজনের কাছে এক এক রকম। কেউ অনেক টাকা কামাতে চায়, কেউ চায় বিখ্যাত হতে, কেউ চায় নিজের সন্তানকে মানুষের মত মানুষ করতে, কেউ চায় অন্যের উপকার করতে, কেউ বা চায় অনেক জ্ঞানী হতে।
তবে, এক একজনের কাছে সাফল্যের রূপ এক একরকম হলেও, সাফল্যের মূল বিষয় একটাই। ১৯৭০ এর দশকের সেলফ ডেভেলপমেন্ট গুরু আর্ল নাইটেঙ্গেল সাফল্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, সাফল্য হল নিজের ইচ্ছায় ঠিক করা কোনও লক্ষ্যকে সফল ভাবে পূর্ণ করাই সাফল্য। সোজা কথায়, নিজের জন্য ঠিক করা লক্ষ্যকে অর্জন করতে পারাই সাফল্য।
কেউ যদি চিন্তা করে সে ব্যবসা করে মিলিওনেয়ার হবে, এবং সেটা হয়ে দেখায় – তবে সে একজন সফল মানুষ। কারও লক্ষ্য যদি থাকে ভালো শিক্ষক হওয়া, যার ছাত্ররা আদর্শ মানুষ হবে, এবং সে যদি তা করতে পারে – তবে সে সফল। কেউ যদি চিন্তা করে সে ভালো একজন স্ত্রী ও মা হবে – এবং সেটা যদি অর্জন করতে পারে – তবে সে সফল।
যে কোনও সাফল্যের জন্যই পরিশ্রম করতে হয়। লক্ষ্য অর্জনের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। এমন অনেক কিছুই করতে হয় যেগুলো সেই মূহুর্তে কষ্টকর। কিন্তু লক্ষ্য অর্জনের জন্য সেই কষ্টকর কাজগুলো হাসিমুখে করতে হয়। – আর এই কারণে অনেকেই তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না।
আবার অনেক সময়ে লক্ষ্য অর্জনের ইচ্ছা ও চেষ্টার কোনও কমতি না থাকার পরও, অনেকেই সফল হতে পারে না। কারণ তারা বুঝতে পারে না, তাদের আসলে কি করা উচিৎ। এই কারণে অনেকের অনুপ্রেরণা হারিয়ে যায়।
বড় লক্ষ্যগুলোর ক্ষেত্রে মানুষ বেশি ঝামেলায় পড়ে। আপনি হয়তো একজন সফল উদ্যোক্তা হতে চান, এবং ব্যবসা করার সুযোগও আপনি দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু কিছু কারণে আপনি চূড়ান্ত ভাবে কাজে নামতে পারছেন না। আপনার হয়তো মনে হচ্ছে আপনি ব্যবসায় নামলেই মার্কেটের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে (যেটা হওয়ার সম্ভাবনা আসলে সব সময়েই থাকে)। অথবা আপনার মনে হতে পারে, আপনি এখনও মাঠে নামার জন্য যথেষ্ঠ দক্ষ হতে পারেননি। – এই ধরনের চিন্তাগুলো মানুষকে শুধুশুধুই দেরি করিয়ে দেয়।
এইসব নেগেটিভ চিন্তার কারণে অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে নিজের বড় লক্ষ্য পূরণের বদলে সাধারণ জীবনকে বেছে নেন। কিন্তু মনে মনে আফসোস করেন – যা তাদের কখনওই শান্তিতে থাকতে দেয় না।
লক্ষ্য পূরণের পথে এই ধরনের অবস্থায় পড়লে কখনও হাল ছেড়ে দেবেন না। বরং হারানো পথ খুঁজে পেতে নিজেকে ৪টি প্রশ্ন করুন। এই প্রশ্নগুলো নিয়ে ঠিকমত চিন্তা করতে পারলে আপনি আবারও নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারবেন। আপনার মাঝে আবার লক্ষ্যকে পাওয়ার আকাঙ্খা শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
নতুন অনুপ্রেরণা পেতে ৪টি প্রশ্ন:
০১. বছরের শেষে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
বড় লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে আমরা অনেক সময়েই পথ হারিয়ে ফেলি, কারণ আমরা বেশিরভাগ সময়েই ৫-১০ বছর পর কি হবে – তা নিয়ে চিন্তা করি। কিন্তু যে কোনও বড় বা দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য পূরণের প্রথম শর্তই হল বড় লক্ষ্যটিকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করা।
আপনার লক্ষ্য যদি থাকে ৫ বছর পর কিছু একটা হওয়া, সেই লক্ষ্যটিকে যত ছোট করে ভাগ করা সম্ভব – তা করুন।
যদি লক্ষের দিকে কাজ করতে করতে একটা সময় পর পথ হারিয়ে ফেলেন, মানে বুঝতে না পারেন যে, কোথায় যাচ্ছেন, বা কি করছেন – তবে নিজেকে প্রশ্ন করুন, দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যকে কি আপনি যথেষ্ঠ ছোট ছোট ভাগে ভাগ করেছেন?
যদি না করে থাকেন, তবে কয়েক বছরের লক্ষ্যকে প্রথমে এক বছর এক বছর করে ভাগ করুন। তারপর বছর গুলোকে ছয় মাস, তিন মাস, এবং এক মাসের লক্ষ্যে ভাগ করে ফেলুন।
এভাবে করতে পারলে আর হতাশ লাগবে না। এক একটি ছোট লক্ষ্য পূরণ করার সাথে সাথে আপনি নতুন করে আরও আত্মবিশ্বাস পাবেন। এবং পরবর্তী ছোট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাবেন। এভাবে ধীরে ধীরে, পথ না হারিয়ে আপনি এক সময়ে লক্ষ্যটি পূরণ করতে পারবেন।
সবচেয়ে ভালো হয় এই লক্ষ্যগুলো একটির পর একটি লিখিত আকার সাজিয়ে রাখলে। মনে মনে ধরে রাখা, অথবা মুখে বলা লক্ষ্যের চেয়ে লক্ষ্য লিখে রাখলে তা সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
০২. নিজের শক্তি আর সুযোগকে কতটা ব্যবহার করেছেন?
লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার একটি প্রধান কারণ, নিজের দক্ষতা ও শক্তিকে পুরোপুরি কাজে না লাগানো। সময়মত লক্ষ্য পূরণ না হলে হতাশ হওয়ার বদলে নিজেকে প্রশ্ন করুন, আমি কি আসলেই আমার পুরো দক্ষতা, শক্তি ও সময়কে লক্ষ্য পূরণের কাজে লাগিয়েছি?
এই প্রশ্নটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময়ে আমরা নিজেরাই বুঝিনা যে, আমরা নিজের দক্ষতার কতটা আসলেই কাজে লাগিয়েছি?
ধরুন একজন দৌড়বিদ ১ মাসের ভেতর নিজের টানা দৌড়ানোর ক্ষমতাকে বাড়িয়ে নিতে চায়। সে হয়তো ৩০ মিনিটে ১ কিলো দৌড়াতে পারতো। এরপর সে ঠিক করেছিল, সে ১ মাসের ভেতরে দেড় কিলো দৌড়ানোর ক্ষমতা অর্জন করবে। কিন্তু ১ মাসের ভেতরে তা করতে না পেরে সে হতাশ হয়ে গেল। কিন্তু দেখা গেল সে প্রতিদিন ২ ঘন্টা প্রাকটিস করেছে, যেখানে সে চাইলে ৩ ঘন্টা প্রাকটিস করতে পারতো।
সত্যিকারে নিজের ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করলে লক্ষ্য পূরণ অনেক সহজ হয়ে যায়। আগেই বলেছি, লক্ষ্য পূরণের জন্য কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। একজন ছাত্র সিলেবাস শেষ করার জন্য ৩ মাস সময় ঠিক করে – যদি তা না করতে পারে, তবে নিজেকে কম মেধাবী মনে করে হতাশ হওয়ার চেয়ে তার উচিৎ নিজেকে প্রশ্ন করা। সে যত ঘন্টা পড়েছে, তারচেয়ে বেশি কি পড়তে পারতো না? প্রতি সপ্তাহে যে ৪ ঘন্টা সে সিনেমা দেখে – তার ২ ঘন্টাও যদি সে পড়ার কাজে লাগাতো, তাহলে হয়তো সিলেবাস শেষ হয়ে যেত।
এরকম প্রতিটি ক্ষেত্রেই যদি আমরা নিজেকে প্রশ্ন করি, তাহলে দেখা যাবে, আমাদের ক্ষমতা বা সুযোগের পুরোটা আমরা ব্যবহার করিনি। – অবশ্য এটা নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বরং এই বাড়তি সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নতুন করে শুরু করার নতুন উৎসাহ খুঁজে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আফসোস করলে আরও সময় বা সুযোগই শুধু নষ্ট হবে।
০৩. লক্ষ্য পূরণে আসলেই কত সময় দরকার?
আগের পয়েন্টটির সাথে এটার কিছুটা সম্পর্ক আছে। তবে শুধু সময় নিয়ে আলাদা আলোচনা করা দরকার বলে এই পয়েন্টটি যোগ করা হল।
আমরা অনেক সময়েই লক্ষ্যের ব্যাপারে খুব বেশি না ভেবেই একটা টাইমলাইন দাঁড় করিয়ে ফেলি। কিন্তু সেই সময়ের মধ্যে লক্ষ্য পূরণ না হলে, বা কাছাকাছি না গেলে হতাশ হয়ে যাই। মনে হয় এই লক্ষ্য পূরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
কিন্তু এমনও হতে পারে, আপনি আসলে যে সময় ধার্য্য করেছেন – সেই সময়ে এটা আসলেই সম্ভব নয়। আপনি হয়তো ঠিকমত হিসাব করেননি।
কখনও যদি মনে হয় সময়মত লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না। এবং এই কারণে যদি হতাশ বোধ করেন, তবে হাল ছেড়ে না দিয়ে একটু রিসার্চ করুন। আপনি যে লক্ষ্য ঠিক করেছেন, তা কি আসলেই এই সময়ের মধ্যে পূরণ করা সম্ভব? – আপনি যতই মেধাবী হন, মাত্র এক বছরের ভেতর একটি নতুন ভাষা পুরোপুরি শেখা সম্ভব নয়, অথবা ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং এর মত বিদ্যা মাত্র ১ বছরে রপ্ত করা সম্ভব নয়। অথবা একটি নতুন ব্যবসাকে মাত্র ১-২ বছরে বড় ব্র্যান্ড বানানো সম্ভব নয়, যদি না অন্য কোনও বড় ইনভেস্টর বা কোম্পানীর সাপোর্ট থাকে।
এগুলোর কথা উদাহরণ হিসেবে বললাম। কিন্তু আমরা অনেক সময়েই কোনও লক্ষ্যের বাস্তব টাইমলাইন নিয়ে ভালোমত গবেষণা না করেই তার জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়ে থাকি। এবং সেই সময়ে লক্ষ্য পূরণ না করতে পারলে হতাশ হয়ে যাই।
এক্ষেত্রে আসলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই, আপনি যদি নিজেকে প্রশ্ন করেন, “আমার লক্ষ্যটি পূরণে বাস্তবিক কত সময় দরকার?, এবং আমি কি আসলেই হিসাব করে সময়সীমা ঠিক করেছি?” – তাহলেই দেখবেন, অনেক কিছু নিজের কাছে পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে।
আবার সময়সীমা হয়তো ১ বছর ধরেছিলেন, এবং সেটা ঠিকও আছে। কিন্তু দিনে ১০ ঘন্টা খাটার বদলে আপনি ৬ ঘন্টা খেটেছেন। – এই কারণেও অনেক সময়ে সময়মত লক্ষ্য পূরণ হয়না।
এই জিনিসগুলোর দিকে নজর দিলে নিজের অনিচ্ছাকৃত অনেক ভুল নজরে আসবে। যেগুলো চাইলেই আপনি শোধরাতে পারবেন। আপনি দেখবেন যে, ব্যাপারটা যত জটিল মনে হচ্ছিল, ততটা জটিল নয়। এর ফলে আপনি হতাশ হওয়ার বদলে আবার নতুন অনুপ্রেরণা নিয়ে লক্ষ্য পূরণের কাজ করতে পারবেন।
০৪. পরিকল্পনা কেন ব্যর্থ হল?
আগেই বলেছি, অনেকেই বড় ঝুঁকি দেখে অনেক সময়ে হাল ছেড়ে দেয়। নিজের লক্ষ্য পূরণের কাজ বাদ দিয়ে দেয়। বেশিরভাগ সময়েই এটা ঘটে যখন মানুষ সাময়িক ব্যর্থতার মুখে পড়ে। একটি প্ল্যান ব্যর্থ হলেই অনেকে লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে আসে।
কিন্তু পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়া মানে নিজেকে নতুন করে চেনার সুযোগ। নিজের ভুলগুলো খুঁজে বের করে, সেগুলো শুধরে নিয়ে – নিজেকে আরও দক্ষ করে তোলার সুযোগ।
তাই এক্ষেত্রে হাল ছেড়ে না দিয়ে, নিজেকে প্রশ্ন করুন, কেন পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হল? – ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তা করুন। বিশ্বস্ত বন্ধু বা সিনিয়রদের সাথে কথা বলুন। দেখবেন নিজের ভুল গুলো বের হয়ে আসছে। অন্যের ওপর বা পরিস্থিতির ওপর দোষ না চাপিয়ে নিজের দিকে তাকান। নিজের ভুলগুলো নিয়ে চিন্তা করুন। কিন্তু নিজেকে শাস্তি দিতে যাবেন না।
তার বদলে ভুলগুলো যাতে আবার না হয়, সেজন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন। এভাবে কাজ করলে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন অনুপ্রেরণা পাবেন।
পরিশিষ্ট:
আমরা অনেক সময়ে সঠিক ভাবে চিন্তা করতে না পেরে, বা মানসিক বন্দীদশা থেকে মুক্ত হতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়ি। যা আসলে হতাশা ও নিরাশা সৃষ্টি করে। লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে আসলে ”ডেড এন্ড” বলতে কিছু নেই। পথ সব সময়েই আছে, শুধু পরিস্কার ভাবে চিন্তা করতে হয়। ঠান্ডা মাথায় পরিস্কার চিন্তা করতে পারলে অনেক জট খুলে যায়। অনেক জটিল জিনিসের সহজ সমাধান বের হয়ে যায়, যা মানুষকে নতুন করে অনুপ্রেরণা দেয়।