বিশেষ: ব্যবসা জগতের একজন জীবন্ত লিজেন্ড, জেনেনিন রতন টাটার জীবনী

রতন টাটার জীবনী অনেকটাই সিনেমার গল্পের মত। বাবা ছেড়ে যাওয়ার পর অসহায় মা ও ছেলেকে ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন দাদী। সেই ছেলে বড় হয়ে খুব ছোট একটা চাকরি নিয়ে ঢোকেন পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে, তারপর এক সময়ে সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়ে বসেন নিজের মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে। তারপর ছোট একটি লোকাল কোম্পানীকে বিরাট এক আন্তর্জাতিক কোম্পানীতে পরিনত করেন। ২১ বছরের মিশনে পৃথিবীর ৬টি মহাদেশের ১০০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে দেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা। তাঁর অবসরের সময়ে কোম্পানীর বার্ষিক আয় ছিল ১০ হাজার কোটি ডলার!আর তাঁর নিজের মোট সম্পদের পরিমান ছিল ৭০ বিলিয়ন ডলারের বেশি!

যে রতন টাটা কে কোম্পানীর বড় পদ দেয়ায় কোম্পানীর লোকজন থেকে শুরু করে মিডিয়া পর্যন্ত সমালোচনায় মুখর হয়েছিল, তাঁরই অবসরের সময়ে সব আফসোসে মরে যাচ্ছিল। কিভাবে তিনি এই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন – তার বিস্তারিত চলুন জেনে নিই রতন টাটার জীবনী থেকে:

ছোটবেলা:
ধীরুভাই আম্বানী এর মত অতটা কষ্ট না করলেও রতন টাটার শেশবও বেশ কষ্টে কেটেছে। রতন টাটার জন্ম হয় ১৯৩৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর ভারতের মুম্বাইয়ে। রতন টাটার বাবা ছিলেন নাভাল টাটা। নাভালের নানী ছিলেন টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজি টাটার স্ত্রী হিরাবাই টাটার আপন বোন। জামশেদজি টাটার ছোট ছেলে স্যার রতনজি টাটা নাভালকে দত্তক নিয়েছিলেন, কারণ তাঁর নিজের কোনও সন্তান ছিল না।
নাভালের প্রথম স্ত্রী সনুর গর্ভে জন্ম নেন রতন টাটা। রতনের বয়স যখন ১০ বছর, তাঁর বাবা তাঁকে, ছোটভাই জিমি ও তাঁর মাকে ছেড়ে, সুইস-ভারতীয় সিমোন টাটাকে বিয়ে করেন।
বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর তাঁর মা এতটাই অসহায় হয়ে পড়েন যে, রতন টাটার আশ্রয় হয় ‘জে.এন, প্রিতিত পার্সি’ নামের এক অনাথ আশ্রমে। সেখান থেকে তাঁর দাদী নবতাজবাই টাটা রতনকে নিয়ে আসেন, এবং দুই নাতি ও পুত্রবধুর দায়িত্ব নেন। রতন তাঁর স‌ৎ ভাই নোয়েল টাটার সাথেই বেড়ে উঠতে থাকেন।

শিক্ষা:
রতন টাটা ছোট বেলা থেকেই বেশ মেধাবী ছিলেন। চ্যাম্পিয়ন স্কুলে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তিনি মুম্বাই এর ক্যাথেড্রাল এ্যান্ড জন ক্যানন স্কুল এবং সিমলার বিশপ কটন স্কুলে পড়াশুনা করেন। ১৯৫৫ সালে নিউ ইয়র্কের রিভারডেল কান্ট্রি স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন, এবং ১৯৫৯ সালে নিউ ইয়র্কের কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে আর্কিটেকচার ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। এছাড়া, ১৯৭৫ সালে তিনি হার্ভাড ইউনিভার্সিটির বিজনেস স্কুল থেকে এ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে একটি কোর্স করেন।

রতন টাটার ক্যারিয়ার:
বিশ্বের অন্যতম সফল ব্যবসায়ী রতন টাটার শুরুটা হয়েছিল ছোটখাট চাকরি দিয়ে।পড়াশুনা শেষ করে তিনি আমেরিকার জোনস এ্যান্ড ইমনস নামে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে কিছুদিন কাজ করেন। তারপর ১৯৬১ সালে তিনি টাটা স্টিল চাকরি শুরু করেন। ব্লাস্ট ফার্নেস দেখাশোনা এবং লাইমস্টোন খোঁড়াখুঁড়ি দেখভাল করার মত ছোট কাজ দিয়ে টাটা গ্রুপে তাঁর যাত্রা শুরু হয়।

তিনি তাঁর মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে ১০ বছরের মধ্যে কোম্পানীর ম্যানেজমেন্টে উঠে আসেন।তিনি প্রায় একক প্রচেষ্টায় টাটা গ্রুপের কোম্পানী ‘ন্যাশনাল রেডিও এ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স’ (নেলকো) কে একটি ভালো অবস্থানে নিয়ে আসেন – কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কোম্পানীটি এক সময়ে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু রতন টাটা মূল কোম্পানীতে বেশ ভালো ভাবেই কাজ করতে থাকেন।

টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হওয়া ও ইতিহাস সৃষ্টি:
১৯৯১ সালে টাটা সন্স এর ত‌ৎকালীন চেয়ারম্যান জে.আর.ডি টাটা অবসরে যাওয়ার সময়ে রতন টাটাকে পরবর্তী চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করেন।

চেয়ারম্যান পদে বসার সাথে সাথেই পুরো কোম্পানী থেকে তিনি চরম বিরোধিতার মুখে পড়েন। কোম্পানীর প্রধান পদাধীকারীদের প্রায় কেউই চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁকে মেনে নিতে চাইছিল না। জে.আর.ডি টাটা কোম্পানীর প্রশাসকদের অতিরিক্ত স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিলেন, ফলে তাদের অনেকেই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিল। এই স্বেচ্ছাচারী অফিসাররাই মূলত রতন টাটার বিরোধীতা করেছিলেন।

এই সমস্যার সমাধানে রতন টাটা কোম্পানীতে চাকরির বয়সসীমা বেঁধে দেন – যাতে করে এইসব সিনিয়র অফিসারদের বেশিরভাগই অবসরে যেতে বাধ্য হন। এছাড়া গ্রুপের অধীনে থাকা কোম্পানীগুলোকে নিয়মিত হেড অফিসে রিপোর্ট করার নির্দেশ দেন, এবং সেইসাথে, প্রতিটি কোম্পানীকে তাদের লাভের একাংশ টাটা ব্র্যান্ড বড় করার পেছনে বিনিয়োগ করার নির্দেশ দেন।

তাঁর আমলে তিনি টাটা গ্রুপের সব কোম্পানীকে একটি প্রশাসনের আওতায় নিয়ে আসেন। গ্রুপের লবণ ও সফটঅয়্যার ব্যবসাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেন।

তাঁর নেতৃত্বে ২১ বছরে টাটা গ্রুপের আয় ৪০ গুণ বেড়েছিল। আর লাভ বেড়েছিল ৫০ গুণ!

তাঁর উদ্যোগে টাটা-টি টেটলি কোম্পানীকে অধিগ্রহণ করে। ১৮৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত টেটলি ছিল বিক্রয়ের দিক থেকে ইউকে ও কানাডার এক নম্বর এবং আমেরিকার দুই নম্বর চা কোম্পানী।

তাঁর আমলে টাটা মোটরস বিশ্বখ্যাত গাড়ির ব্র্যান্ড জাগুয়ার এ্যান্ড রোভার কে অধিগ্রহণ করে। সেইসাথে, টাটা স্টিল অধিগ্রহণ করে লন্ডন ভিত্তিক ‘কোরাস’ কে।

এইসব অধিগ্রহণের ফলে টাটা গ্রুপ ভারতীয় একটি লোকাল কোম্পানী থেকে ইন্টারন্যাশনাল জায়ান্ট কোম্পানীতে পরিনত হয়। এর ফলে টাটা গ্রুপের আয়ের ৬৫% বিশ্বের ১০০টি দেশে পন্য বিক্রয়ের মাধ্যমে আসতে থাকে। বিশেষ করে টাটার বাস ও ট্রাক সারা বিশ্বে জনপ্রিয়। এছাড়া টাটার জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার গাড়ি তো সারা বিশ্বেই অভিজাত গাড়ি হিসেবে সমাদৃত। এসবের বাইরে ভারতের সবচেয়ে বড় আউটসোর্সিং ফার্মও টাটা গ্রুপের।এছাড়া চাইনিজ মোবাইল ব্র্যান্ড শাওমির বেশ বড় অংশের শেয়ারের মালিকানাও টাটা গ্রুপের। ৩০ হাজার রুপীর কম পুঁজিতে শুরু করা কোম্পানীটিকে রতন টাটা নিজের হাতে ট্রিলিয়ন ডলার কোম্পানী বানিয়েছেন। সাতটি ব্যবসায়িক খাতে গ্রুপটির রয়েছে ১০০টি প্রতিষ্ঠান। আইটি, ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক্স, কেমিকেল, খাদ্য, টেক্সটাইল – সব ক্ষেত্রেই টাটা গ্রুপের যে সদর্প বিচরণ, তার কারিগর এই রতন টাটা।

যে রতন টাটাকে চেয়ারম্যান করায় সব ক্ষেপে উঠেছিল, ২০১২ সালে অবসরের ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে সবাই তাঁকে থেকে যাওয়ার জন্য বার বার অনুরোধ করেছিল।

টাটা গ্রুপের বাইরে:
টাটা গ্রুপের বাইরেও তাঁর বেশকিছু বিনিয়োগ রয়েছে। মূলত নতুন সম্ভাবনাময় ব্যবসাতে তিনি এই বিনিয়োগ গুলো করেছিলেন – যার ফলে ব্যবসাগুলো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি।

ভারতের অন্যতম ই-কমার্স ওয়েবসাইট স্ন্যাপডিল এ তিনি নিজের পকেট থেকে বিনিয়োগ করেছিলেন। এছাড়া অনলাইনে ভারতীয় চা এর বিক্রেতা ‘টিবক্স’, ক্যাশ ব্যাক ওয়েবসাইট ‘ক্যাশকারো ডট কম’ – এও তিনি বিনিয়োগ করেছেন। এসবের বাইরে আমেরিকান এক্সপ্রেসেও তাঁর ব্যক্তিগত বিনিয়োগ রয়েছে।

শিক্ষায় অবদান:
# হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি:

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে খুব অল্পদিন পড়লেও প্রতিষ্ঠানটির প্রতি রতন টাটার দারুন মায়া জন্মেছিল। ২০১০ সালে টাটা গ্রুপ হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে একটি এক্সিকিউটিভ সেন্টার নির্মানের জন্য ৫ কোটি মার্কিন ডলার প্রদান করে। হলটির নামও দেয়া হয় টাটা হল। এটি মূলত পেশাজীবিদের ব্যবসায়িক শিক্ষার জন্য ব্যবহার হবে।

# কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটি:
অটোমোবাইল নিয়ে গবেষণার জন্য টাটা কনসালনেন্সি সার্ভিস যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগী মেলন বিশ্ববিদ্যালয়কে সাড়ে তিন কোটি মার্কিন ডলার প্রদান করে।

# ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি:

২০১৪ সালে টাটা গ্রুপ ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিকে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য টেকনোলজি পন্য উদ্ভাবন করার গবেষণা করার জন্য পঁচানব্বই কোটি রুপী প্রদান করে। প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় অনুদান।

অন্যান্য সদস্যপদ:
টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে থাকা ছাড়াও রতন টাটা আরও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন ও আছেন।

তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বানিজ্য ও শিল্প বিষয়ক একজন প্রধান উপদেষ্টা, এবং ভারতের ‘ন্যাশনাল মেনুফ্যাকচারিং কম্পিটিটিভনেস কাউন্সিল’ এর সদস্য।

স্থাপত্য শিল্পে বিশ্বের অন্যতম সম্মানজন পুরস্কার “প্রিজকার আর্কিটেকচারাল প্রাইজ” এর একজন জুরিও তিনি। বিশ্বের ৮ নম্বর এ্যালুমিনিয়াম প্রস্তুতকারক কোম্পানী, আমেরিকার এ্যালোকা আইএনসি এবং আমেরিকান মাল্টি ন্যাশনাল ফুড কোম্পানী মনডিলেজ ইন্টার ন্যাশনালের একজন বোর্ড অব ডিরেক্টর রতন টাটা। এছাড়া তিনি ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ণ ক্যালিফোর্নিয়ার একজন ট্রাস্টি।

এসবের বাইরেও আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথে বিভিন্ন ভাবে জড়িত আছেন এই ব্যবসায়ী।

এইসব সদস্যপদের বাইরেও তিনি দুইবার ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান পদ্মভূষণ লাভ করেছেন। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রীর পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে এ পর্যন্ত মোট ৪০টি পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে বিজনেস ফর পিস এবং এশিয়ান বিজনেস এ্যাওয়ার্ডও রয়েছে।

পরিশিষ্ট:
সাধারণত যে কোনও বড় কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতারাই লিজেন্ড হয়ে থাকেন। কিন্তু রতন টাটা কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা না হয়েও ব্যবসার জগতে লিজেন্ড হয়ে গেছেন। শুধু ভারতে নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশের ব্যবসায়ীরাই রতন টাটাকে গুরু মানেন।

ছোট একটি পদ দিয়ে শুরু করে একটি কোম্পানীর সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়ে তাকে এতবড় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডে পরিনত করার উদাহরণ আর খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। ব্যবসার হাল কিভাবে ধরতে হয় – তা শিখতে হলে রতন টাটার জীবনী নিশ্চই একটি ভালো শিক্ষার উ‌ৎস। আশা করি এই জীবন্ত কিংবদন্তীর জীবনী থেকে আপনিও এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাবেন।

লেখাটির ব্যপারে আপনার মতামত আমাদের কমেন্ট করে জানান। আপনার সব মতামতই আমাদের কাছে অমূল্য।

Related Posts

© 2024 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy