‘সাবেক এক সৈন্য রূপান্তরিত হলো সুন্দরী নারীতে’। এই শিরোনামে ১৯৫২ সালের পহেলা ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পত্রপত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়। যা যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে আলোড়ন তৈরি করে। ডেইলি নিউজ নামের একটি পত্রিকা কিনতে পাঠকরা ভিড় করেছিল স্টলগুলোতে। পত্রিকাটির প্রচ্ছদে এই প্রথম সফলভাবে কারো লিঙ্গ পরিবর্তনের খবর প্রকাশিত হয়।
সাবেক এই মার্কিন সৈন্যের নাম ছিল জর্জ জোর্গেনসন। ইউরোপের একটি দেশ ডেনমার্কে অপারেশনের মাধ্যমে তিনি তার লিঙ্গ পরিবর্তন করে হন একজন নারী। পরে তার নাম হয় ক্রিস্টিন জোর্গেনসন। অস্ত্রপাচারের দুমাস পরে এ সংক্রান্ত আরো একটি খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। যাতে ছাপা হয় এক সুন্দরী নারীর ছবি। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে পশমের তৈরি মোটা কোট পরে হালকা পাতলা ওই নারী নিউ ইয়র্কের এয়ারপোর্টে বিমান থেকে নেমে আসছেন।
সেখানে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরেন। এরপর রাতারাতি এটা এক চাঞ্চল্যকর বিষয়ে পরিণত হয়। পরে ক্রিস্টিন হলিউডের এক জনপ্রিয় তারকায় পরিণত হন। টাইট রুটস আওয়ার একজন ড্যানিশ তথ্যচিত্র নির্মাতা এবং ডাক্তার। তার সঙ্গে ক্রিস্টিন জোর্গেনসনের কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। ১৯৮০ এর দশকে তিনি ক্রিস্টিনের ওপর একটি সিনেমা নির্মাণ করেন।
ক্রিস্টিনের শৈশব জীবন ছিল স্বাভাবিক। কিশোর বয়স থেকে তিনি অনেক কিছু ভিন্নভাবে অনুভব করতে শুরু করেন। তার মনে হতো যে তার মনটা যেন অন্য কোথাও আটকা পড়ে আছে।
ডেনিশ তথ্যচিত্র নির্মাতা বলেছেন, ক্রিস্টিন তাদের জানিয়েছেন যে সেনাবাহিনীতে তাকে ভয়ভীতি দেখানো হতো। তার সঙ্গে যেসব দীর্ঘদেহী পুরুষ সৈন্য ছিল তারা তাকে পুরুষ বলে মনে করতো না। আপনি যদি তার সেসময়ের ছবি দেখেন তাহলে দেখবেন যে তাকে একজন সমকামী পুরুষের মতো দেখাচ্ছে। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমি নিশ্চিত যে তারা সবাই তাকে সমকামী পুরুষ বলেই মনে করতো যা সেনাবাহিনীতে হয়তো তার জন্য সমস্যা তৈরি করেছিল।
ক্রিস্টিন জোর্গেনসন কখনো নিজেকে সমকামী পুরুষ হিসেবে পরিচয় দেননি। তিনি বরং নিজেকের পুরোপুরি একজন নারী বলেই মনে করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন এবং বিভিন্ন স্কুলে কাজ করতে শুরু করেন। এসময় তিনি লিঙ্গ পরিবর্তনের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে শুরু করেন।
টাইটসের তথ্যচিত্রে ক্রিস্টিন জোর্গেনসন বর্ণনা করেছেন কিভাবে তিনি কোপেনহাগেনের ডাক্তারদের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ করেছিলেন। তাদের একজন ছিলেন ড. ক্রিস্টিয়ান হ্যামবুর্গার। জোর্গেনসন নিজেই ছিলেন ড্যানিশ বংশোদ্ভূত। যোগাযোগ হওয়ার পর ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলতে তিনি চলে যান ওই শহরে।
ক্রিস্টিন বলেন, পত্রিকায় একটা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল যাতে ড. হ্যামবুর্গার কী কাজ করছিলেন সেসব বিষয় তুলে ধরা হয়। এরপর তিনি ড. হ্যামবুর্গারকে ফোন করেন। ক্রিস্টিন যখন ড. হ্যামবুর্গারের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। তখন ড. হ্যামবুর্গার তাকে দেখে বলেছিলেন ওহ, তোমাকে তো ছেলেদের মতো দেখাচ্ছে না। তিনি বিশ্বাস করেন যে ক্রিস্টিন একজন নারী। ইউরোপে ক্রিস্টিন প্রথম যে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করলেন তিনিই তাকে একথা বললেন। এতে ক্রিস্টিন কিছুটা সস্তি পায় যে, তাকে কেউ চিনেছে এবং সঠিক মানুষের কাছেই তিনি এসেছে।
ক্রিস্টিনের মনোচিকিৎসক ইয়র্গ স্টিরুপ তাকে পরীক্ষা করে জানালেন যে, অপারেশনের জন্য তিনি ফিট আছেন এবং ড্যানিশ আইন পরিবর্তনের জন্যেও তিনি একটা রাস্তা খুঁজে বের করলেন।
কিন্তু তার পরেও কিছু বিষয়নিয়ে তারা খুবই চিন্তায় ছিল। ক্রিস্টিনের চিকিৎসক ইয়র্গ স্টিরুপ কিম্বা হ্যামবুর্গারের এবিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু কাগজপত্রে রেকর্ড খুঁজে পাওয়া গেল যে এর আগেও কিছু ডাক্তার অপারেশনের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন।
লিঙ্গ পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রথম অস্ত্রোপাচার হয়েছিল জার্মানির বার্লিন শহরে ১৯২০ এবং ১৯৩০ দশকে। কিন্তু সেগুলো সফল হয়নি। লিলি এলবা নামের এক ব্যক্তির শরীরে কয়েক দফায় অস্ত্রোপাচার করা হয় এবং এর ফলে তিনি মারা যান। ওই প্রক্রিয়া সফল না হলেও জোর্গেনসনের ডাক্তাররা সেসব থেকে কিছু দিক-নির্দেশনা পেয়েছিলেন। পরে এক বছর ধরে জোর্গেনসন বাড়িতে থেকে নানা ধরনের চিকিৎসা গ্রহণ করেন এবং পরে তার দেহে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের অস্ত্রোপাচার করা হয়।
ডেনমার্কে যখন এই অস্ত্রোপাচারের খবরটি প্রকাশিত হয়, ১৯৫০ এর দশকে ডেনমার্কে রক্ষণশীল সংস্কৃতি সত্ত্বেও জোগেনসনকে খুব বেশি বিরূপ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি। এটা এতই অভিনব ঘটনা ছিল যে লোকজন স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল। সেসময় এর কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়নি। কারণ যেসব ডাক্তার এই অস্ত্রোপাচার করেছিলেন তারা সামাজিকভাবে ছিলেন খুবই উঁচু শ্রেণির। তারা যেমন তাকে সেরা চিকিৎসা দিতে পেরেছিলেন, তেমনি তারা এর অনুকূলে একটা পরিবেশও তৈরি করতে পেরেছিলেন। তখন বলা হয়েছিল এটা বৈধ এবং অনেক গবেষণার পর এই অস্ত্রোপাচার করা হয়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত সবকিছু ঠিক ঠাক মতোই হয়েছে।
অস্ত্রোপাচার সফল হওয়ার পর আমেরিকা থেকে অনেক নারী ক্রিস্টিন জোর্গেনসনের ডাক্তার হ্যামবুর্গারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তারাও তাদের লিঙ্গ পরিবর্তনের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। ১৯৮০ এর দশকে ক্রিস্টিন ঘোষণা করেন যে তিনি দেশে ফিরে যেতে চান এবং তার এই ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রে আলোড়ন তৈরি করে।
১৯৭০ এর দশকে ক্রিস্টিন বিবিসিকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন যাতে তিনি তার রোমান্টিক জীবন নিয়ে কথা বলেছেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল নারী হওয়ার পর তাকে কোনো সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছিল কি না। জবাবে ক্রিস্টিন বলেছিলেন, পুরুষরা ডেট করতে চাইত না শুধু একারণে নয় যে আমি ভিন্ন ধরনের এক নারী, আমি একজন তারকাও বটে। মার্লিনা ডিটরিখ এটা অনেকবার উল্লেখ করেছেন। এটা খুব বিব্রতর এক পরিস্থিতি। পুরুষরা মনে করেন এই নারী এত জনপ্রিয় যে তারা প্রত্যাখ্যাত হতে পারেন। তারা মনে করতো যে এই নারীর তো আমার জন্য সময় হবে না। ফলে কেউ সেরকম প্রস্তাব দিত না।
দুবার সম্পর্কে জড়ালেও ক্রিস্টিন জোর্গেনসন কখনও বিয়ে করেননি। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার পর ক্রিস্টিন জোর্গেনসন ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস করতে শুরু করেন এবং হয়ে ওঠেন হলিউড সেলেব্রিটি। তিনি একটি বই লিখেছেন। বেশ কিছু ছবিতে ও মঞ্চে অভিনয় করেছেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর।