বিশেষ: বাঈজির কণ্ঠে ভজন শুনে কেঁদেছিলেন বিবেকানন্দ, ডেকেছিলেন ‘মা’! কেন?

আঠারো শতকের শেষ এবং উনিশ শতকের দিকে বাঈজিদের ঘিরে এক প্রকার দ্বন্দ্ব কাজ করেছে উচ্চশ্রেণির মানুষের। এক দিকে, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং নৃত্য— শিল্পের এই দুই মাধ্যমের অগ্রণী শিল্পী তারা। একই সঙ্গে তাদের কাছেই আবার বাঁধনহীন যৌনতার হাতছানি।
একটা সময় বেশির ভাগ বাঈজি থাকতেন কলকাতার চিৎপুরে। জনশ্রুতি, অযোধ্যার নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের হাত ধরেই কলকাতায় উত্তর ভারতীয় ঘরানার বাঈজিদের আগমন। চিৎপুরে বাঈজিদের থাকার ব্যবস্থাও নাকি করেন ওয়াজিদ আলি শাহ।

আবার গবেষকদের একাংশের মতে, নব মুন্সির আমদানি এই বাঈজি-সংস্কৃতি। কিছু কিছু গবেষকের অবশ্য দাবি, কলকাতায় বাঈনাচ পরবর্তী পর্যায়ে পৌঁছেছিল রাজা নবকৃষ্ণ দেবের হাত ধরে। নবকৃষ্ণের ইংরেজ আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। নবকৃষ্ণই আবার কবিয়াল হরু ঠাকুর ও নিতাই দাসের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার সভায় বাঈনাচের আয়োজন হলে সমাজের এলিট সাহেব-সুবো আর বাবুরা নিমন্ত্রণে যেতেন।

ধীরে ধীরে বৌবাজার, বাগবাজার, পাইকপাড়া এবং বেলঘরিয়ায় তাদের আস্তানা গড়ে ওঠে। সে সময় একটা প্রবাদ চালু ছিল, ‘চল্‌ পানসি বেলঘরিয়া!’ অর্থাৎ নব্য বাবুরা নৌকা করে বেলঘরিয়ায় যাবেন বাঈজি-সঙ্গ উপভোগ করতে।

বিখ্যাত বাঈজিদের যে নাম বিভিন্ন বইয়ে পাওয়া যায়, তারা হলেন, নিকি বাঈ, অসরুন জিন্নাত, বেগম জান, মির্জা জান, হিরা বুলবুল, গওহর জান, নুরজাহান, মালকা জান, জানকি বাই (ছপ্পান ছুরি), জদ্দন বাই (অভিনেত্রী নার্গিসের মা), কোহিনুর, ইন্দুবালা প্রমুখ।

১৮২৩ সালে রাজা রামমোহন রায়ের বাগানবাড়িতে নাকি বাঈয়ের নাচ দেখেছিলেন মিস ফানি পার্কস। সে সময়ের প্রসিদ্ধ গায়িকা ছিলেন হিরা বুলবুল। এদের মধ্যে রেষারেষিরও উল্লেখ পাওয়া যায় বিভিন্ন বইয়ে।

বাঈজি সঙ্গীত শুনেছিলেন বিবেকানন্দও। বিবেকানন্দ তখন গিয়েছেন খেতড়ীর রাজার আমন্ত্রণ রক্ষা করতে। খেতড়ী রাজসভায় বসেছে মজলিশ। শেষ অনুষ্ঠান, বাঈগান। এ সব জেনেশুনে বিবেকানন্দ সভা ছেড়ে বেরোতে চাইছেন।

খেতড়ীর রাজা তখনই বিবেকানন্দকে অনুরোধ করলেন আরো কিছুক্ষণ থেকে যাওয়ার জন্য। অতঃপর, কী আর করেন বিবেকানন্দ! এমন অনুরোধে শেষ পর্যন্ত আর না বলতে পারলেন না।

বাঈজি গান ধরলেন ‘প্রভু মেরে অবগুণ চিত্ না ধর। সমদরশি হ্যায় নাম তুমহারও, চাহে তো প্যার করো…।’ বাঈজি গাইছিলেন। চোখ বন্ধ করে গান শুনছেন ‘বালক-বীর’। গান শেষ হওয়ার পর দেখা গেল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। বিবেকানন্দের চোখের জলে জোয়ার লেগেছে।

এই ঘটনা বিবেকানন্দের জীবনে গভীর রেখাপাত করে। পরবর্তীকালে বিবেকানন্দ যতবার খেতড়ী গিয়েছেন, তার একটাই দাবি ছিল: ‘আমার মাকে ডাকো। আমি ওর গান শুনব।’

এই ঘটনার বহু বছর পরে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের এক সন্ন্যাসী পরবর্তী ঘটনার অনুসন্ধান করতে করতে রাজস্থানের খেতড়ী পৌঁছন। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন সেই বাঈজির নাম ময়নাবাঈ।

অসামান্যা সুন্দরী এবং সুগায়িকা ছিলেন ময়না। রাজস্থানের বহু রাজা তার গান শোনার জন্য সে সময় উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। কিন্তু অজানা কারণে সেই সে দিনের পর থেকে তাকে আর কেউ দেখতে পাননি।

মিশনের ওই সন্ন্যাসী অনুসন্ধান শুরু করেন। তারপর সেখান থেকে বহু দূরে রাজপুতানার এক প্রত্যন্ত গ্রামে খুঁজে পেয়েছিলেন সেই বাঈকে। তিনি তখন বৃদ্ধা। ছোট্ট কুটিরে থাকেন। একা। তার সঙ্গে থাকেন তার সারা জীবনের আরাধ্য দেবতা— গিরিধারী শ্রীকৃষ্ণ এবং স্বামী বিবেকানন্দ। পটে আঁকা ছবির সামনে তিনি গান শোনান। পুজো করেন। নিজের সন্তানের মতো খাওয়ান। ঘুম পাড়ান…।

রামকৃষ্ণ মিশনের সেই সন্ন্যাসী ওই বাঈজির কাছেই শোনেন তার কথা। ময়নাবাঈ বলেছিলেন, ‘আমি সেদিন আমার জীবন্ত গোপালকে গান শুনিয়েছিলাম। সেই গান তারপর আর কাউকে শোনাইনি। আমি সব ছেড়ে চলে এসেছি এই গ্রামে। আমার দেবতাদের নিয়েই আমার জীবন কাটিয়ে দেবার জন্যে। আমি সাক্ষাৎ ভগবানকে দেখেছি, তিনি আমার গান শুনেছেন, আমার জীবন ধন্য হয়ে গিয়েছে।’

বিবেকানন্দের প্রিয় গানের তালিকায় জায়গা করে নেয় এই ভজন। অনেক পরে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে রামকৃষ্ণ মিশনের এক শীর্ষস্থানীয় মহারাজের অনুরোধে বিবেকানন্দের প্রিয় গানের একটি সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। শিল্পী ছিলেন অজয় চক্রবর্তী এবং তার স্ত্রী চন্দনা চক্রবর্তী।

বিবেকানন্দের প্রিয় গানের তালিকায় জায়গা করে নেয় এই ভজন। অনেক পরে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে রামকৃষ্ণ মিশনের এক শীর্ষস্থানীয় মহারাজের অনুরোধে বিবেকানন্দের প্রিয় গানের একটি সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। শিল্পী ছিলেন অজয় চক্রবর্তী এবং তার স্ত্রী চন্দনা চক্রবর্তী। এই ভজনটি চন্দনা গেয়েছিলেন ওই সঙ্কলনটিতে। যদিও গানটির ইতিহাস সেখানে বলা হয়নি।

রামকৃষ্ণনন্দকে (শশী মহারাজ) ২৩ অগস্ট ১৮৯৬ সালে সুইৎজারল্যান্ডের লেক লুসান থেকে এক চিঠিতে বিবেকানন্দ লেখেন, ‘বেশ্যারা যদি দক্ষিণেশ্বরের মতো মহাতীর্থে যেতে না পারে, তবে যাবে কোথায়? পাপীদের জন্য স্রষ্টার যত প্রকাশ, পূণ্যবানদের জন্য কিন্তু ততটা নয়। হ্যাঁ, ভেদাভেদ সংসারে আছে, থাকবে, থাকুক না। কিন্তু তীর্থতেও যদি এ রকম ভেদাভেদ হয়, তবে তীর্থ আর নরকে ভেদ কী…?’

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy