বিশেষ: বাংলায় বিস্কুট ছিল নিষিদ্ধ খাবার, জেনেনিন কি করে হলো এর প্রচলন?

বিস্কুট খেতে কে না ভালোবাসেন। ছোটরা তো বটেই, বড়রাও সকালের নাস্তায় কিংবা বিকেলে চায়ের সঙ্গে বিস্কুট না হলে চলেই না। অনেক দেশেই বিস্কুটকে বলা হয় কুকিজ। সে যাই বলুন না কেন, কুকি, কুকিজ কিংবা বিস্কুট পছন্দের তালিকায় আছে সবারই। কত শত স্বাদের বিস্কুট পাওয়া যায় এখন।

তবে প্রথম কখন কোথায় বিস্কুট খাওয়া শুরু হয়েছিল জানেন কি? বিস্কুট মূলত ময়দা দিয়ে বিভিন্ন আকারে বেক করা হয়। সাধারণত- এগুলো চিনি, চকলেট, জাম, আদা বা দারুচিনির স্বাদ দিয়ে বানানো হয়। ল্যাটিন শব্দ বিস ও ককটাস থেকে বিস্কুট শব্দটির আগমন ঘটেছে। বিস শব্দের অর্থ দুইবার আর ককটাস শব্দের অর্থ রান্না করা বা বেকড। প্রাথমিকভাবে দুই ধাপে বেক করার মাধ্যমে বিস্কুট বানানো হতো। প্রথমে বেক করা হতো। এরপর স্লো ওভেনে সেঁকা হতো। এখন অবশ্য একবারেই বিস্কুট বানানো হয়।

এই শুকনো খাবারটি আসলে আবিষ্কার হয়েছিল সময়ের প্রয়োজনেই। প্রাচীনকালে এর উদ্ভব। তখন রোমান, গ্রিক ও মিশরীয় সাম্রাজ্যের বণিক এবং সামরিক কর্মীদের দীর্ঘ সময় সমুদ্রে থাকতে হত। তাই তাদের এমন একটি নাশতার প্রয়োজন ছিল, যা পুরো ভ্রমণে প্রয়োজনীয় ক্যালরির যোগান দেবে। কারণ, তাজা খাবার দ্রুত পচে যায় বলে- তাই তাজা খাবার দিয়ে তা সম্ভব ছিল না। তখন ময়দা দিয়ে কম আঁচে রান্না করা রুটি তাদের প্রধান খাবার হয়ে ওঠে। সেই রুটি থেকে ধীরে ধীরে বিস্কুটের উদ্ভাবন হয়। মধ্যযুগে সমুদ্রে বিস্কুট খুব জনপ্রিয় ছিল।

সপ্তম শতাব্দীর আগে বিস্কুটকে মিষ্টি খাবার হিসেবে খাওয়ার আধুনিক ধারণার প্রচলন হয়নি। পরে পারস্যরা বিস্কুট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে। তারা ময়দার সঙ্গে ডিম, মাখন ও ক্রিম অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করে। এরপর তারা এর সঙ্গে ফল ও মধুর মতো মিষ্টি জিনিস ব্যবহার করে প্রথম কুকিজ তৈরি করে।

দশম শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপে বিস্কুটের আগমন হয়। প্রচলিত আছে, একজন আর্মেনীয় সন্ন্যাসী মধ্য এশিয়া থেকে ফ্রান্সে ভ্রমণ করেন। তিনি ককাসে যে রেসিপি শিখেছিলেন তা সবার মাঝে বিতরণ করেন। এভাবেই ইউরোপে বিস্কুটের পথচলা শুরু হয়।

এক সময় ব্রিটিশ বিস্কুট ব্যবসা বাজারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৩১ সালে ব্রিটিশ কোম্পানি হান্টলি অ্যান্ড পামারস বিস্কুটের টিন উদ্ভাবন করে। ফলে, সারা বিশ্বে বিস্কুট রপ্তানি শুরু হয়। ১৯০০ সালের মধ্যে হান্টলি অ্যান্ড পামারসের বিস্কুট ১৭২টি দেশে বিক্রি হয়েছিল।

তবে বাংলা অর্থাৎ ভারতবর্ষে কিন্তু বিস্কুট খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল একটা সময়। বিস্কুটকে মনে করা হতো ইংরেজিকরণের প্রতীক। আর বর্ণপ্রথা বিদ্যমান থাকা হিন্দু সমাজে বিস্কুটকে ‘অপবিত্র’ খাদ্য হিসেবে মনে করা হতো। অবশেষে সেই সমস্যার সমাধান করলেন লালা রাধামোহন। ১৮৯৮ সালে দিল্লিতে ‘হিন্দু বিস্কুট কোম্পানি’ চালু করেন রাধামোহন । কোম্পানির এক বিজ্ঞাপনে ঘোষণা করা হয়েছিল, উৎপাদন থেকে প্যাকেজিং; সবকিছুই হয়েছে শুধুমাত্র উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের হাতের স্পর্শে।

যদিও ভারতীয়রা শত শত বছর ধরেই বিস্কুট জাতীয় খাবার; তা হয়তো অন্য কোনো নামে বা রন্ধনপ্রণালীতে তৈরি করে এবং খেয়ে আসছেন। আরব, অতপর পারস্য এবং পরে ইউরোপীয়; নতুন নতুন শাসকের আগমনে স্বাদ এবং প্রস্তুত প্রণালীতে পরিবর্তন এসেছে কেবল। তবে ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে বিস্কুট এবং চায়ের মিশেলের সঙ্গে পরিচয় এবং তা জনপ্রিয়তা পায় ব্রিটিশ আমলে।

‘দ্য বিস্কিট: দ্য হিস্ট্রি অব আ ভেরি ব্রিটিশ ইনডালজেন্স’ বইয়ের লেখক খাদ্য ইতিহাসবিদ লিজি কলিহাম বলেন, গোয়া এবং পন্ডিচেরির বেকারিতে যখন পর্তুগিজ এবং ফরাসি বিভিন্ন খাদ্য তৈরি শুরু হয় তখনই ব্রিটিশদের দখলে থাকা প্রধান শহর কলকাতা, মাদ্রাজ এবং বোম্বেতে ইংরেজদের কেক এবং বিস্কুটের প্রচলন শুরু হয়।

হান্টলে অ্যান্ড পালমার্স-এর মতো কোম্পানি তখন ব্রিটেন থেকে ভারতে বিস্কুট আমদানি করতো। যদিও বিস্কুটের বাজার ছিল সীমাবদ্ধ। বিস্কুট তখন শ্রমিক শ্রেণির নাগালের বাইরে থাকা অভিজাত এক নাস্তা হিসেবে পরিচিত ছিল। আর অন্যদিকে, বর্ণপ্রথায় বিশ্বাসী হিন্দুদের জন্য বিস্কুট ছিল নিষিদ্ধ।

এখন দেশিয় অনেক কোম্পানি নানা স্বাদের ও গন্ধের মিশেলে তৈরি করছে। যা রসনা মেটাচ্ছে বিস্কুটপ্রেমীদের।
সূত্র: ন্যাশনাল টুডে, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy