আমি কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে যতটা না দেরি, তারও আগে ওপাশ থেকে সেই শব্দটা প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছিল। আমি খুব বিস্মিত হলাম! এটা কীভাবে হচ্ছে? আমি আবার বললাম, ‘ভেতরে খুব অন্ধকার…’, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিধ্বনি হলো খু…ব খু…ব খু…ব … অন্ধ… তার… অন্ধ… তার অন্ধ…তার। যেন আমার কথাগুলোই কয়েক শ’ লোক চিৎকার করে ফিরিয়ে দিল।
জেল গেটের প্রহরীরা বলল , ভেতরে যে বন্দিরা আছে তারা কোনো মানুষ কেন, বিগত কয়েক বছর কোনো প্রকার আলোই দেখেনি। আমরা জাতিসংঘের অফিসার বলেই নাকি গেটের কাছে আসতে পেরেছি, বিগত ৫/৭ বছরে এখানে কেউ আসেনি।
সিয়েরা লিওনের গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ থেকেই অনেক রাষ্ট্রদ্রোহীকে এখানে বন্দী করা হয়। কেউ যাবজ্জীবন, কেউ ১০ বছর, কেউবা ৮ বছর মেয়াদের জেল খাটছে এখানে। এতোদিনে এদের অনেকেই বিকারগ্রস্থ বন্য প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। তাই বাইরের দুনিয়ার কোনো শব্দ শুনতে পেলে ওরা সঙ্গে সঙ্গে সেটার পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। কথাগুলো বন্ধ জেল খানার চার দেয়ালে ইকো হয়ে ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে।
জেলখানার দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে আমি দিব্য চক্ষে ঠিকই জেলের ভেতর রাখা অসংখ্য কঙ্কালসার বিকারগ্রস্থ বিদ্রোহী মানুষদেরকে দেখতে পেলাম। যাদের কেউ দেশের জন্য, কেউ নিজ জাতির জন্য, কেউ নিজ গোষ্ঠীর জন্য যুদ্ধ করতে এসে বন্দী হয়েছে। যারা হয়তোবা এতদিনে এই অন্ধকার জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে।
পাপেল আইল্যান্ডের এই যুদ্ধ বন্দীদের জেলখানা দেখতে গিয়েছিলাম আমি আর ইউনামসিলের কমিউনিকেশন অফিসার ব্রিগেডিয়ার শাহাদাত। সিয়েরা লিওনের রাজধানী ফ্রি টাউন থেকে পাপেল আইল্যান্ড পর্যন্ত কমিউনিকেশন লিংক স্থাপনের প্ল্যান তৈরি করার জন্য। মামিইয়োকো হোটেলের হেলিপ্যাড থেকে একটি পাকিস্তানি দ্রুতগামী হেলিকপ্টারে করে আমরা ৬/৭ জনের একটা টিম এসেছিলাম। হেলিকপ্টার এতো দ্রুত চলতে পারে আমার ধারণা ছিল না।
হেলিকপ্টারে উঠার আগে আমার এক ইরানি কলিগের সঙ্গে দেখা হলে, সে সাবধান করে দিয়ে বলেছিল, একা একা যেন কোথাও ঘুরতে না যাই। কারণ এই দ্বীপের কালো মানুষরা সাদা মানুষদের একা পেলে ধরে খেয়ে ফেলে। এরকম গল্প অনেক শুনেছি, আফ্রিকার অনেক দেশেই নাকি ওরা মানুষের মাংস খাওয়াকে খারাপ মনে করে না।
জেলখানা পাড় হয়ে বাম দিকে আগালেই বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা। পাহাড় বললে ভুল হবে, উঁচু উঁচু টিলার সারি, গাঢ় সবুজ গাছে ঢাকা। এই পাহাড়ের ভিতর দিয়ে আঁকা বাঁকা দুর্গম পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে গেলেই পাওয়া যাবে এক অদ্ভুত রাজ্য, যেখানে ঐ মানুষ খেকো ক্যানিবেলরা থাকে। বছর কয়েক আগে, জাতিসংঘের একটি টিম ঐ পথে গিয়েছিল, স্থানীয়রা বার বার নিষেধ করার পরও। টিমটি বিকেলে ফিরে আসার পর রহস্যজনকভাবে তাদের একজনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেইদিন সারা রাত আর পরের সারা দিন ধরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও পাওয়া যায়নি সেই মানুষটাকে। সপ্তাহখানেক পরে, একটি লেকের পাশে ঐ কর্মকর্তার ব্যবহার্য কাপড়চোপড় আর কিছু হাড় গোড় পাওয়া গিয়েছিল। যাতে করে বুঝা গেলো, ঐ সাদা মানুষটাকে ক্যানিবেলরা খেয়ে নিয়েছে।
আমি গভীর কালচে সবুজে ঢাকা পাহাড়ি টিলাগুলোর দিকে তাকিয়ে মানুষখেকো নিবেলগুলোর চিৎকারই যেন শুনতে পেলাম অন্ধকার জেলের ভেতর বন্দী বিদ্রোহী কালো মানুষগুলোর কণ্ঠে। আমি আবার শব্দ করলাম, ‘কু…কু…’; ভেতর থেকে এক লক্ষ কণ্ঠের যান্ত্রিক ‘কু…কু…’ শব্দের প্রতিধ্বনি অনুরিত হতে হতে গাঢ় সবুজ পাহাড়গুলোতে মিলিয়ে গেল।