বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মূল পটভূমি গ্রাম। গ্রামীণ মানুষের আচার-আচরণ, বিশ্বাস, মনন-রুচি, ধ্যান-ধারণা, চিত্তবিনোদনের প্রাণবন্ত ও প্রাকৃতিক রূপ আমাদের লোকজ ঐতিহ্যের মূল ভিত্তি। এই সংস্কৃতি একদিনে গড়ে ওঠেনি। বছরের পর বছর মানুষের চিত্রায়ণের ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি এমন ঐতিহ্য। আবার আমরাই আমাদের গড়ে তোলা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। বর্তমানে লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নগর সংস্কৃতি দ্বারা বিপর্যস্ত।
বাংলা লোকজ খেলাধুলায় বৈচিত্র্যময় এবং ভরপুর ছিল। লাঠিখেলা, বউছি, টোপাভাতি, কানামাছি, কাবাডি, কুতকুত, গোল্লাছুট, ষাঁড়ের লড়াই, নৌকাবাইচ, পুতুল খেলা, মার্বেল খেলা এখন নেই বললেই চলে। এসব স্থান পেয়েছে ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন। এ ছাড়াও উন্নত প্রযুক্তির ফলে শিশু-কিশোররা নানা রকম মোবাইল গেমস (পাবজি, ফ্রি-ফায়ার) এ আসক্ত হয়ে পড়েছে।
লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বলতে বর্তমানে যা আছে, তা অনেকটা- দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো অবস্থা। লোকসংস্কৃতির অনেক উপাদানই আজ বিলুপ্তপ্রায়।
নকশি কাঁথা
বাংলাদেশের লোকশিল্পের একটা অংশ নকশি কাঁথা। আবহমানকাল ধরে এ দেশের মানুষ নকশি কাঁথা ব্যবহার করে আসছে। নারীরাই এই শিল্পে বেশি দক্ষ। দুপুরের বা রাতের খাবারের পর গ্রামের নারীরা একসাথে বসে গল্প করতে করতে সেলাই করেন এক একটি নকশি কাঁথা। তাই বলা হয় নকশি কাঁথা এক একজনের মনের কথা বলে। এক একটি নকশী কাঁথা তৈরি করতে কখনো কখনো প্রায় এক বছর সময় লেগে যায়। নকশী কাঁথা সাধারণত দুই পাটের অথবা তিন পাটের হয়ে থাকে। সাধারণ কাঁথা সেলাইয়ের পর এর ওপর ফুঁটিয়ে তোলা হতো বিভিন্ন নঁকশা যার মধ্যে থাকে ফুল, লতা, পাতা ইত্যাদি।
বাঁশ ও বেত
দেশে যে কয়েকটি প্রাকৃতিক উপাদান লোকজীবনের সঙ্গে মিশে আছে, বাঁশ ও বেত সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। গ্রামের নারী-পুরুষ উভয়ই বাঁশ ও বেতের কাজে জড়িত । কোন কোন এলাকায় নারীরা বেতের কাজে পুরুষদের চেয়ে বেশি দক্ষ। বাঁশ ও বেতের তৈরি কুলা, চালন, খাঁচা, মই, চাটাই, ঢোল, গোলা, ওড়া, বাউনি, মাচা, ঝুঁড়ি, ডুলা, মোড়া, মাছ ধরার চাঁই, সোফাসেট, বইপত্র রাখার র্যাক, আসবাবপত্র, বাঁশের ঘর, বেড়া, ঝাপ, বেলকি, দরমা ইত্যাদি এ দেশের নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতির প্রতীক। দিন দিন ঐতিহ্যবাহী বাঁশ আর বেত শিল্পের তৈরি বিভিন্ন পন্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় বাঁশ ও বেতের হস্তশিল্প বিলুপ্ত হওয়ার পথে।
যাত্রাপালা
আমাদের সংস্কৃতির শেকড়ের সন্ধান করতে গেলে সবার আগে উঠে আসবে যাত্রাশিল্পের নাম। সত্তর দশকের দিকে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিলো যাত্রাপালা। যাত্রাপালার বেশিরভাগ কাহিনী আর গল্পগুলো রচনা করা হতো সমাজে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা নিয়ে। গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন হাট-বাজার, মাঠ, পাড়া, মহল্লাসহ বিভিন্ন এলাকায় এক সময় জমে উঠত যাত্রাপালা।
জোসনা রাতে সামাজিক এ যাত্রাপালা দেখতে দলবেধে ছুটে যেত ছোট বড় সব বয়সীরা। এ সংস্কৃতি মানব সমাজ ও রাষ্ট্রের সামাজিক অবক্ষয় দূর করতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম নিদর্শন এই যাত্রাপালা আজ হারিয়ে গেছে।
নৌকাবাইচ
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকাবাইচ বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি অংশ। মুসলিম যুগের নবাব-বাদশাহদের আমলে নৌকা বাইচ বেশ জনপ্রিয় ছিল। শিশু-কিশোর থেকে বৃদ্ধ সবার কাছেই জনপ্রিয় নৌকাবাইচ। আমাদের দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে এখনো দেখা যায় নৌকা চালানো প্রতিযোগিতা বা নৌকা বাইচ। নৌকাবাইচের সময় বাইচা বা মাঝিরা সমবেত কণ্ঠে যে গান গায়, যেগুলো সারিগান নামে অভিহিত। নৌকাবাইচে অংশগ্রণকারি শ্রমজীবী মানুষের পেশাবদল, নদী, খাল, বিল শুকিয়ে যাওয়া সব মিলিয়ে নৌকা বাইচ কম দেখা যায়।
ষাঁড়ের লড়াই
একসময় আমাদের দেশে ষাঁড়ের লড়াই একটি প্রসিদ্ধ খেলা হিসেবে প্রচলিত ছিল। লড়াই করার জন্য ষাঁড় গরু আলাদাভাবে লালন পালন করা হতো। শুকনো মৌসুমে গ্রামের বাজারে ঢোল পিটিয়ে আমন্ত্রন জানানো হতো ষাঁড়ের লড়াই দেখার। লড়াই শুরুর আগে ষাঁড়ের মালিকগণ তাদের ষাঁড়গুলোকে বিভিন্ন রঙিন কাপড়, ঘুংগুর দিয়ে মাঠে আসতেন।
বর্ণিল রঙের ষাঁড়ের উপস্থিতি প্রতিযোগিতাকে প্রাণবন্ত করে রূপ দিত উৎসবের। অনেক সময় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকটি ষাঁড়কে দেওয়া হতো বিভিন্ন ও বিচিত্র নাম। তবে প্রাণি কল্যাণ সংস্থাগুলোর বিরোধিতা, তহবিল সংকট এবং ধর্মীয় কারণসহ বিভিন্ন উদ্বেগের কারণে ঐতিহ্যবাহী ষাঁড়ের লড়াই আজ নেই বললে চলে।
লাঠি খেলা
লাঠি খেলা একটি ঐতিহ্যবাহী বাঙালি মার্শাল আর্ট। আবহমানকাল ধরে বিভিন্ন অঞ্চলে বিনোদনের খোরাক জুগিয়েছে এই লাঠিখেলা। এই খেলার জন্য খেলোয়াড়দের প্রয়োজন হয় এক একটি লাঠি, যেটি সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা, এবং প্রায়ই তৈলাক্ত হয়ে থাকে।
কৌশলের সঙ্গে প্রত্যেক খেলোয়াড় তাদের নিজ নিজ লাঠি দিয়ে রণকৌশল প্রদর্শন করতেন। এই খেলায় শুধুমাত্র বলিষ্ঠ যুবকেরাই অংশ নিতেন। লাঠি খেলার অসাধারণ ইতিহাস থাকলেও এই খেলার নতুন দল তৈরি না হওয়া, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবসহ নানা কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা।
বায়োস্কোপ
বায়োস্কোপ বাংলার বিনোদনের একটি লোকজ মাধ্যম। কাঠের বাক্সে চোখ লাগিয়ে গানের তালে তালে বিভিন্ন ধরনের ছবি দেখানোকে বলা হয় বায়োস্কোপ। আগেকার দিনে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার কাছেই বেশ জনপ্রিয় ছিল বায়োস্কোপ। তবে শিশুদের সবচেয়ে বড় বিনোদনের মাধ্যম ছিলো এটি।
ইতিহাস সূত্র জানা যায়, বিদেশি উদ্যোক্তা স্টিফেন্স ১৮৯৬ সালে একটি থিয়েটার দলের সঙ্গে কলকাতায় আসেন এবং বায়োস্কোপ প্রদর্শন করেন। এরপর তার দেখাদেখি মানিকগঞ্জের হীরালাল সেন ১৮৯৮ সালে বাণিজ্যিকভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে বায়োস্কোপ দেখানো শুরু করলে এটি হয়ে ওঠে অনন্য এক বিনোদন মাধ্যম। তখনকার সময় বায়োস্কোপ ছিলো গ্রাম বাংলার সিনেমা হল।
তাঁত
বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো ও বৃহত্তম শিল্প হলো তাঁত। সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এ অঞ্চলে তাঁত শিল্পের প্রচলন শুরু হয়। তাঁতের পোশাক আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ। তাঁত শিল্পের ঐতিহ্য সর্বজনবিদিত। বিশেষ করে এদেশের মসলিন ও জামদানির রয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি।
তাঁতের শাড়ির সাধারণত শক্ত, চওড়া পাড় ও আঁচল থাকে, জমিন তুলনামূলক স্বচ্ছ হয় এবং জমিনে নানা নকশা কাটা হয়। ধনেখালি,ভিটি, জামদানি,ঢাকাই তাঁতসহ আরো অনেক বৈচিত্র্য রয়েছে তাঁতের কাপড়ের। তবে, নানা কারণে বাংলাদেশে তাঁতের সংখ্যা অতীতের তুলনায় অনেক কমে গেছে। ক্রমেই তাঁতিরা আধুনিক পাওয়ার-লুম মেশিনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন।
লোক সঙ্গীত
বাংলাদেশের সঙ্গীতের একটি অন্যতম ধারা হচ্ছে লোকসংগীত। এটি মূলত বাংলার নিজস্ব সঙ্গীত। গীত,বাদ্য ও নৃত্য এই তিনের সমন্বিত রূপ হচ্ছে সঙ্গীত। এদিক থেকে লোকগীতি, লোকবাদ্য ও লোকনৃত্য এই তিনের সমন্বিত রূপকে লোকসঙ্গীত বলা যায়। বাউল সঙ্গীত লোকসঙ্গীতের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কেননা বাউল গান গীত,বাদ্য ও নৃত্য সহযোগে পরিবেশিত হয়। বাংলা লোকসঙ্গীত বৈচিত্র্যময়।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মানুষের মুখে মুখে বিকাশ ঘটে এই লোকসঙ্গীতের। লোকসঙ্গীত মূলত আঞ্চলিক ভাষায় উচ্চারিত হয় এবং এতে প্রকৃতির প্রাধান্য থাকে সবচেয়ে বেশি। দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখও প্রকাশ পায় লোকসঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে।
আধুনিকতাকে ছুড়ে ফেলে নয়, বরং লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমেই আধুনিকতার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করাই হচ্ছে জাতিসত্তা। কারণ, লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ছাড়া বাঙালি শেকড়হীন পরগাছার মতোই। যাদের কোনো অর্থ থাকে না, স্থায়ী অস্তিত্ব থাকে না। নতুন প্রজন্মকে আমাদের লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। তবেই হয়ত বাঁচবে বাঙালির স্বকীয়তা।