বিশেষ: দেশে বসেই বিদেশের ৪টি কোম্পানি সামলান বাঙালি তরুণী,জেনেনিন সাফল্যের কাহিনী

দেশে বসেই বিদেশের ৪টি কোম্পানি সামলান তিনি – দেশে বসেই বিদেশের চার প্রতিষ্ঠান সামলাচ্ছেন তিনি। আয়ের অঙ্ক শুনলে যে কারও চোখ কপালে উঠে যাবে। অনলাইনের একটি মার্কেটপ্লেস থেকেই তাঁর মাসে গড়ে দুই লাখ টাকা আয় হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন মার্কেটপ্লেস

আপওয়ার্কে শীর্ষ আয়ের তালিকায় জ্বলজ্বল করছে তাঁর নাম। তিনি মেরিলিন আহমেদ। ফ্রিল্যান্সিংয়ে মেয়েদের অনেকখানি এগিয়ে যাওয়ার বার্তা বহন করছেন মেরিলিন। দেশে বসেই বিদেশের চারটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কর্মী নিয়োগ দেওয়া, মানবসম্পদ বিভাগ দেখাসহ প্রতিষ্ঠানের গুরুদায়িত্ব পালন করছেন মেরিলিন আহমেদ। ফ্রান্সের একটি কোম্পানি তাঁকে সে দেশে চলে যেতে বললেও তিনি

দেশেই গড়ে তুলতে চাইছেন মানবসম্পদ নিয়ে কাজ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান। ফ্রিল্যান্সিং জীবন নিয়ে সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। ব্যবসা ও চাকরির পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিংয়ে যুক্ত থাকলেও মেরিলিন আহমেদ নিজেকে পুরোপুরি ফ্রিল্যান্সার হিসেবেই পরিচয় দেন। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ, এমবিএ ও পরবর্তী সময়ে মানবসম্পদ–বিষয়ক ডিপ্লোমা পিজিডিএইচআর করে দেশের কয়েকটি নামকরাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। সামলেছেন দেশের বড় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগের দায়িত্ব। কিন্তু চাকরির বাঁধাধরা সময় তাঁর পছন্দ হয়নি বলে বেছে নেন ফ্রিল্যান্সিং পেশাটাকে। কারণ, এখানে নিজের স্বাধীন সময়মতো কাজ করার সুবিধা আছে। এর বাইরে নিজের সুবিধাজনক সময়কে চাকরির জন্য বেছে নিয়েছেন। গত এক বছর দেশের ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পিজিডিএইচআর কোর্স

পড়াচ্ছেন। সঙ্গে নিজের ব্যবসা শুরু করে আয়ের পরিধিটুকু বাড়িয়ে নিতে পেরেছেন বহু গুণ। একসঙ্গে এখন তিন ধরনের কাজ সামলাচ্ছেন মেরিলিন। মেরিলিন জানালেন, ফ্রিল্যান্সিং জগতে তিনি প্রধানত মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক ও প্রকল্প পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। তিনি আপওয়ার্কের শীর্ষ আয়ের ফ্রিল্যান্সারদের একজন। সরকারের কাছ থেকেও স্বীকৃতি পেয়েছেন।

বিষয় তাঁকে দেখতে হয়। মেরিলিন জানালেন, গত তিন বছরে তিনি অনলাইনে নিয়োগ দিয়েছেন ৪৫০ জনেরও বেশি আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্স কর্মীকে। ওই চারটি প্রতিষ্ঠানের জন্য তাঁর কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা তাঁর ওপর ভরসা করেন। সরাসরি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ কারণে তাঁদের সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে কাজ করতে হয়। পুরো কাজ করতে হয় অনলাইনে। সময়ের ব্যবধানের সুবিধা হিসেবে তিনি ইউরোপীয় গ্রাহকদের সঙ্গেই কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। যেভাবে ফ্রিল্যান্সিংয়ে এলেন জবাবে মেরিলিন জানান, ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে পড়াশোনা করে ফ্রিল্যান্সিংয়ে আসার ইচ্ছে কখনো ছিল না। সে সময় ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রসার ও প্রভাব সম্বন্ধে জানাও ছিল না। তবে করপোরেট চাকরি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বিকল্প চিন্তা করছিলেন। চাকরি ছেড়ে তখনই এ পথে আসা। তবে শুরুটামোটেও সহজ ছিল না।

তিনি মার্কেটপ্লেসগুলো নিয়মিত ঘেঁটেছেন। কাজ খুঁজেছেন। অনেকের মতোই ডেটা এন্ট্রি, লেখালেখির মতো কাজগুলো পেতে আবেদন শুরু করেন। সেটা ২০১৩ সালের দিকে। এরপর প্রথম কাজ পেতেই ছয় মাস সময় লাগে। তিনি ধৈর্য হারাননি। প্রথম কাজ সফলভাবে শেষ করার পর আরও কয়েকটি কাজ করেন। কিন্তু তিনি যে বিষয়ে দক্ষ, সে বিষয়টিতে কাজ পাচ্ছিলেন না। এর মধ্যে শুরু করেন নিজের প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা। সেই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ও আয় বাড়াতে ফ্রিল্যান্সিংকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। একসময় কাজ পেয়ে যান এক বিদেশি গ্রাহকের, যার সঙ্গে পরে অনলাইনের বাইরেও নিজের মানবসম্পদবিষয়ক পরামর্শ ব্যবসা শুরু করেন তিনি। মেরিলিন থাকেন রাজধানীর বনশ্রীতে। তাঁর কার্যালয় পান্থপথে।

বাবা–মায়ের বড় সন্তান তিনি। ছোট দুই ভাই আছেন, যাঁরা তাঁদের আপন পেশার ক্ষেত্রে সফল। প্রকৌশলী বাবা ও গৃহ ব্যবস্থাপক মায়ের সান্নিধ্যে মেরিলিনের ছোটবেলা কেটেছে লিবিয়ায়। সেখানে বাংলা মাধ্যমে পড়েছেন। ১০ বছর বয়সে দেশে চলে আসেন। এরপর থেকে তিনি দেশের প্রচলিত মাধ্যমে পড়েছেন। এখন তিনি মানবসম্পদ–বিষয়ক পরামর্শ, নিয়োগ ও নীতিমালা তৈরির কাজগুলো করছেন। আর অবসর মুহূর্তগুলো আজকাল তিনি বিদেশ ভ্রমণ করে কাটান। কীভাবে এত সব সামলাচ্ছেন? এর জবাবে হেসে মেরিলিন বললেন, সবাই জয়টা দেখতে পায়। পেছনের কঠোর অধ্যবসায়, নিদ্রাহীন রাত, অশেষ ধৈর্য আর সুচিন্তিত পদক্ষেপগুলো কেউ দেখতে পায় না। তাঁর জয়ের মন্ত্র একটাই—নিজের সবচেয়ে ভালোটা দেওয়া। টাকার দিকে চেয়ে নয়; বরং মন দিয়ে পরিশ্রমের মাধ্যমে সাফল্য পেয়েছেন।

নিজেকে প্রমাণে নিজের সিদ্ধান্তই প্রয়োগ করতে হবে—এই তাড়নাটুকুও টেনে নিয়ে এসেছে অনেকখানি। মেরিলিন জানান, ফ্রিল্যান্সিংকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে পরিবারের দিক থেকে সমর্থন পেয়েছেন তিনি। তবে বড় প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য শুনতে হয়েছে তির্যক মন্তব্য। শুরুতে বাবা–মায়ের কিছুটা আপত্তি থাকলেও পরে তাঁরা পাশে দাঁড়িয়েছেন। শুরুতে ফ্রিল্যান্সিংয়ে নিজেকে মানিয়ে নিতেও কিছুটা সময়ের দরকার হয়েছে। কী করে ভালো ক্লায়েন্ট পাওয়া যায়, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের সেবা দিতে এখনো নিজেকে প্রতিনিয়ত তৈরি করে যাচ্ছেন। নতুন নতুন দক্ষতা অর্জন করতে হচ্ছে। শিখতে হচ্ছে। নতুনদের জন্য পরামর্শ নতুন যাঁরা ফ্রিল্যান্সিং পেশায় আসতে চান, তাঁদের জন্য ভাষাগত কোনো বাধা দেখেন না মেরিলিন। তাঁর মতে, কাজ শিখে পেশাদার মনোভাব নিয়ে এগোলে সফল হওয়া যাবে।

এ ক্ষেত্রে গুগল, ইউটিউবসহ নানা শেখার উপকরণ রয়েছে। আগে শিখতে হবে, চর্চা করতে হবে। এরপর মেন্টরিং। ফ্রিল্যান্সিং পেশায় কেউ কাউকে কাজ দিতে পারে না। নিজের কাজ নিজের যোগ্যতায় আদায় করতে হয়। একজন ভালো মেন্টর অবশ্য কাজে আসতে পারে। তবে নিজের বস নিজেকেই হতে হবে। মেরিলিন বলেন, যাঁরা সন্তান জন্মের পর চাকরি ছেড়ে বসে থাকেন,তাঁরা এ পেশায় আসতে পারেন। এ ছাড়া ঘরে বসে থাকার চেয়ে কাজ শেখাকে গুরুত্ব দেন তিনি। বলেন, বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আগে দক্ষতা বাড়াতে হবে। আজকাল ফ্রিল্যান্সিংয়ের ওপর ভালো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সরকারি ও বেসরকারি, দুই পর্যায়েই আছে। অনেকে ইউটিউব, ফেসবুকেও টিউটোরিয়াল দিয়ে থাকেন। পাশাপাশি বইও পাওয়া যায় প্রচুর। আর কিছু না হোক, নিজে থেকে অনলাইন সার্চ করেও জেনে নেওয়া যায় প্রাথমিক অনেক তথ্য। এরপর কাজে নামতে পারেন। শুরুতেই কাজের আশা না করে, নিজের যোগ্যতা বুঝে এগোতে হবে। রাতারাতি সাফল্য আসে না। মেরিলিনের মতে, ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণা আছে। ঢালাওভাবে ফ্রিল্যান্সিং সবার জন্য—এ ধারণাটা ভুল।

আবার যাঁদের দেশীয় বাজারে কাজ নেই, ফ্রিল্যান্সিং তাঁদের জন্য, সেই ধারণাও ভুল। তবে আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসে কাজ করার দক্ষতা থাকলে কারও ভাবাভাবির দিকে না চেয়ে কাজ শুরু করে দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, কাজ যেন চাইতে না হয়, কাজই যেন আপনাকে খুঁজে নেয়, সেভাবে এগোতে হবে। এ লক্ষ্যেই নিজের একটি আন্তর্জাতিক মানের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন বলে জানালেন।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy