আপনি সাধারণভাবে যে পদ্ধতিতেই জীবন যাপন করেন না কেন – এই ৪টি পরামর্শ কিছুদিন অনুসরন করলে আপনার একটি নতুন অভ্যাস গড়ে উঠবে। লক্ষ্য কেন্দ্রিক এবং অভ্যাস কেন্দ্রিক পদ্ধতির সুফল আপনি একসাথেই পাবেন।
চলুন তাহলে টিপসগুলো জেনে নেয়া যাক:
০১. বড় লক্ষ্যটিকে ছোট ছোট লক্ষ্যে ভাগ করুন
প্রতিটি মানুষই জীবনে কিছু পেতে চায়। সবারই বড় লক্ষ্য থাকে। লক্ষ্য কেন্দ্রিক জীবনযাপন করা মানুষরা জীবনের বড় লক্ষ্য গুলো বেশি পূরণ করতে পারেন। এর কারণ তাঁরা তাঁদের বেশিরভাগ সময় ও শ্রম লক্ষ্যের পেছনে দেন। অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন ও পরিশ্রম করেন।
অন্যদিকে অভ্যাস কেন্দ্রিক জীবনযাপন করা মানুষরা বড় লক্ষ্য ঠিক করলেও সেটার জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে চান না, অথবা খুব বেশি কষ্ট করতে চান না। লক্ষ্য কেন্দ্রিক মানুষ যখন প্রচন্ড্র ঘুম আসলেও কাজ শেষ না করে কিছুতেই ঘুমাতে চান না। অভ্যাস কেন্দ্রিক মানুষ একটু ঘুম আসলেই পরের দিনের জন্য কাজ ফেলে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন।
অভ্যাস কেন্দ্রিক মানুষ যেমন বড় লক্ষ্য পূরণ করতে না পেরে আফসোস করেন, তেমনি লক্ষ্য কেন্দ্রিক মানুষ জীবনের ছোট ছোট আনন্দ গুলো মিস করায় আফসোস করেন।
এই দুই ধরনের মানুষের জন্যই জীবনটা আরও সুন্দর ও সহজ হয় যদি তারা তাদের বড় লক্ষ্যকে ছোট ছোট লক্ষ্যে ভাগ করে নেয়।
একটু ব্যাখ্যা করি; ধরুন, দুইজন মানুষের লক্ষ্য ৫ বছরের মধ্যে কোটিপতি হওয়া। এদের একজন লক্ষ্য কেন্দ্রিক মানুষ, আরেকজন অভ্যাস কেন্দ্রিক।
একজন দুনিয়ার বাকি সবকিছু ভুলে শুধুই লক্ষ্য পূরণের জন্য কাজ করে। আরেকজন মন চাইলে কাজ করে – মন না চাইলে করে না। একজন ৫ বছর পর ঠিকই কোটিপতি হল, কিন্তু তার জীবন থেকে অন্য সব আনন্দ হারিয়ে গেল। এটা তারজন্য আফসোসের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। আরেকজন কোটিপতি হতে পারলো না। এইজন্য সে সব সময়ে আফসোস করতে লাগলো।
এখন, এই দুইজন মানুষই যদি তাদের বড় লক্ষ্যটিকে ছোট ছোট লক্ষ্যে ভাগ করে নিত, তাহলে দু’জনই সফল হত। এবং সফল হওয়ার পাশাপাশি কারও কোনও আফসোস থাকতো না।
সাধারণ অবস্থা থেকে কোটিপতি হওয়া অবশ্যই বেশ বড় লক্ষ্য। এই লক্ষ্যটিকে যদি প্রতিদিনকার কাজে ভাগ করে নেয়া যায় – তবে মাথার ওপর অনেক কম চাপ পড়বে। প্রতিদিন যদি একটি নির্দিষ্ট পরিমান শ্রম ও সময় এই লক্ষ্য পূরণের পেছনে দেয়ার পরিকল্পনা থাকে – তবে দুই ধরনের মানুষই উপকৃত হবেন।
লক্ষ্য কেন্দ্রিক মানুষ দিনের পুরো সময়টা লক্ষ্যের পেছনে দেবেন না। তার বদলে একটি দিনের জন্য ঠিক করা লক্ষ্য পূরণের কাজ করবেন। এতে নিজের জন্য ব্যক্তিগত কিছু সময় তিনি পাবেন। এবং জীবনের অন্যান্য বিষয়গুলো মিস করবেন না।
আর অভ্যাস কেন্দ্রিক মানুষ যদি বড় একটি লক্ষ্যকে প্রতিদিনকার ছোট ছোট লক্ষ্যে ভাগ করে কাজ করেন, তাহলে তাঁর ওপর মানসিক চাপ অনেক কম পড়বে। তিনি দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় বড় লক্ষ্য পূরণের কাজ করে, তারপর যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন।
এভাবে কাজ করলে দুই ধরনের মানুষই নিজের জন্য সময় পাবেন। সেইসাথে লক্ষ্য পূরণের কাজও এগুবে। দিন শেষে লক্ষ্যও পূরণ হবে এবং ব্যক্তিগত কোনও আফসোসও থাকবে না।
০২. একটা পর্যায়ে সফল হওয়ার পর অন্যদের দিয়ে কাজ করান
একটু বিনোদন, পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের সাথে সময় কাটানো, পারিবারিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা, মাঝে মাঝে শুধুই মজার জন্য কিছু খাওয়া – এগুলো প্রতিটি মানুষই চায়। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ হয় এগুলো বেশি করে ফেলে, অথবা করেই না। দুই ধরনের মানুষেরই এটা নিয়ে আফসোস থাকে। যারা বেশি করে, তারা সত্যিকার প্রোডাক্টিভ কাজের সময় নষ্ট করে আফসোস করে। আর যারা পুরোটা সময়ই প্রোডাক্টিভ কাজ করে, তারা জীবনের বেশিরভাগ মজা গুলো মিস করে। প্রিয়জনের থেকে দুরে সরে যায়।
এক্ষেত্রে এমন একটা ব্যবস্থা করা যায়, যার ফলে দুই দিকই ঠিক থাকে। সোজা বাংলায়, যাতে সাপও মরে কিন্তু লাঠিও না ভাঙে।
পৃথিবীর বেশিরভাগ সেলফ ডেভেলপমেন্ট ও পারফরমেন্স কোচের মতে, যখনই সম্ভব হয় যোগ্য কাউকে কাজ দিয়ে দেয়া উচিৎ। ধরুন আপনি দুই বছর ধরে বেশ কষ্ট করে নিজের ব্যবসাকে একটি ভালো জায়গায় নিয়ে এসেছেন। এখন আপনি মোটামুটি একজন সফল উদ্যোক্তা। কিন্তু এই দুই বছরে পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবকে খুব একটা সময় দিতে পারেননি। এমনকি অনেক সময়ে তাদের প্রয়োজনেও পাশে থাকতে পারেননি।
কিন্তু এখন যখন একটি ভালো অবস্থায় চলে এসেছেন – তখন কিছু কাজের জন্য আস্তে আস্তে যোগ্য লোক নিয়োগ দিতে শুরু করুন। এতে করে আপনি অনেকটা সময় পাবেন। এই সময়টা আপনি জীবনের অন্যান্য দিকগুলো পূর্ণ করার জন্য কাজে লাগান। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবকে সময় দিন, নিজের পেছনে সময় ব্যয় করুন। এতে করে সব দিক দিয়েই আপনি সফল ও সুখী হবেন।
০৩. নিজের ও কাছের মানুষদের জন্য আলাদা করে সময় রাখুন
পরিবার, বন্ধবান্ধব ও আপনজনদের জন্য আলাদা করে সময় রাখুন। যারা আপনাকে ভালোবাসে, সেই ভালোবাসার মূল্য দেয়াটাও আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। জীবনে সফল হতে গেলে এটারও প্রয়োজন আছে।
আপনি যে ধরনের জীবনযাপনেই অভ্যস্ত হোন না কেন – যদি আপনজনদের জন্য আলাদা করে সময় রাখেন – তাহলে নিজের কাজের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনেও সুখী হবেন।
আপনি লক্ষ্য কেন্দ্রিক অথবা অভ্যাস কেন্দ্রিক যেমনই হন না কেন – দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়, অথবা সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিন নিজের পরিবার, বন্ধুবান্ধব, ও অন্যান্য আপনজনদের জন্য বরাদ্দ রাখুন। এতে করে কাজের সময়ে যেমন নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারবেন – তেমনি ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেও সম্পর্কগুলো ঠিক রাখতে পারবেন। ফলে পেশাগও ও ব্যক্তিগত – দুই ক্ষেত্রেই আপনি সফল হবেন।
০৪. সব সময়ে একই পথে চলবেন না
আপনি লক্ষ্য কেন্দ্রিক মানুষই হন, অথবা অভ্যাস কেন্দ্রিক – সব সময়ে একই ভাবে চলা জীবনকে একঘেয়ে করে দেয়। অনেকদিন একই ভাবে চললে এমনিতেই বিরক্তি ধরে যায়। মনে হয়, “কি করলাম এতদিন?” – আর এটাই আমাদের সত্যিকার সুখী হতে দেয় না।
আপনি হয়তো অভ্যাসের বশে প্রতিদিন ফাস্টফুড খান। এর ফলে শরীরে বাড়তি মেদ জমছে। অলসতা বাড়ছে। শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু তবুও আপনি ফাস্টফুড খাওয়া বন্ধ করছেন না। কারণ এটা আপনার অভ্যাস হয়ে গেছে।
আবার ধরুন, আপনি খুব পুষ্টি মেইনটেন করে খাবার খান। ঘরে বানানো শাক সব্জী, মাছ – ইত্যাদি পুষ্টিকর খাবার ছাড়া কিছুই খান না। এরপরও হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে গেলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কিছুই ভালো লাগে না। সব রাগ গিয়ে পড়ে নিয়ম মেনে চলার ওপর।
আসলে দু’টোকে ব্যালেন্স করে চলা উচিৎ। ভার্জিন গ্রুপের সিইও এবং সফল উদ্যোক্তা রিচার্ড ব্র্যানসন খুব ব্যস্ত একজন মানুষ। খুবই নিয়মের মধ্যে চলেন। কিন্তু তিনি মাঝে মাঝে হারিয়ে যান। তাঁর একটা দ্বীপ কেনা আছে। যেখানে তিনি মাঝে মাঝে চলে যান অবকাশ যাপনের জন্য। সেখানে পিকনিক করেন, নিজের মত করে সময় কাটান। কাজের ধারেকাছে যান না। তাঁর মতে এটা তাকে পরবর্তী কাজের জন্য চাঙ্গা করে। মন প্রফুল্ল হয়।
শুধুই কাজ করলে বা বিনোদন করলে জীবন একঘেয়ে হয়ে যায়। তাই পুরো মাস বা সপ্তাহ একই ভাবে না কাটিয়ে মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ নিজের মত করে সময় কাটাতে হয়। এতে করে কাজের সময়ে পূর্ণ মনোযোগে কাজ করা যায়। সেইসাথে জীবনকেও উপভোগ করা যায়। কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনে সাফল্য পাওয়ার জন্য এটা খুবই জরুরী।
পরিশিষ্ট:
শুধু ক্যারিয়ার বা কাজের ক্ষেত্রে সাফল্য পেলে যেমন জীবনের অন্য দিকগুলো অপূর্ণ থেকে যায়, তেমনি কাজের দিকে নজর না দিয়ে শুধু ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও একই ঘটনা ঘটে। সত্যিকার সফল জীবন মানে সব ক্ষেত্রেই ভালো থাকা। আপনি নিজের চেষ্টায় বিশাল কিছু করলেন, কিন্তু আপনার সন্তানকে ঠিকমত মানুষ করতে পারলেন না – এটা আসলে সাফল্য নয়। সবদিক সুন্দর ভাবে ব্যালেন্স করে চলতে পারলেই আসলে প্রকৃত সুখী হওয়া যায়। আর সেই পথে এই লেখাটি আপনাকে একটু সাহায্য করলেই আমাদের উদ্দেশ্য সফল।
লেখাটির বিষয়ে আপনার যে কোনও মতামত আমাদের কমেন্ট করে জানান। আপনার প্রতিটি মতামতই আমাদের কাছে মহামূল্যবান।