বিশেষ: গ্রাম বাংলার সংস্কৃতি থেকে কেন হারিয়ে গেল যাত্রাপালা? জেনেনিন বিস্তারিত

প্যান্ডেলের চারদিকে অপেক্ষমান দর্শক। কোন সময় শুরু হবে যাত্রাপালা। অবশেষে এক সময় সানাই বেজে ওঠে। দর্শকরা এক পর্যায়ে চুপ। লাইটের কম্পন আর ড্রামের তালে মঞ্চে প্রবেশ করলেন একাব্বর বাদশা আর তার উজির।
বাদশা বলেন, ‘শোনো উজির, আমি শুনলাম প্রজারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। কী ষড়যন্ত্র করছে এবং কেন করছে বলতে পারো?’ এ প্রশ্নের উত্তর দিতে উজির আমতা-আমতা করেন। তখন বাদশা অভয় দিলে উজির বলেন, ‘কী বলব জাঁহাপনা, আপনার ছেলে-মেয়ে নাই। খোদা আপনাকে আটকুঁড়ে করে রেখেছেন। প্রজারা বলছে, আপনার মুখদর্শনে অন্ন জোটে না, তাই সবাই এ রাজ্য ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার কথা ভাবছে।’

টানটান উত্তেজনা আর দর্শকের উৎকণ্ঠাকে পুঁজি করে এভাবেই এগিয়ে চলছে যাত্রা পালার গল্প। সারা রাত জেগে দর্শকরা উপভোগ করছিলেন এ যাত্রাপালা।

একটা সময় ছিল, যাত্রাপালা দেখতে ছোট বড় সব বয়সীরা দল বেঁধে ছুটে যেত। কিন্তু কালের বিবর্তনে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির হাজার বছর ধরে মিশে থাকা বিনোদনের অন্যতম নিদর্শন এ যাত্রাপালা গান আর চোখে পড়ে না। এতে করে অস্তিত্ব সংকটে আছে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত শিল্পীরা।

একদিকে যেমন হারিয়ে যেতে বসেছে যাত্রাপালা অন্যদিকে যাত্রাপালার শিল্পীরা হয়ে পড়েছেন বেকার। ফলে জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে যাত্রাপালার অভিনয় জগত থেকে সরে যাচ্ছেন শিল্পীরা।

যাত্রাশিল্পের এখন ঘোর দুর্দিন। এর প্রধান কারণ যাত্রাপালায় অশ্লীলতা। ধীরে ধীরে আমাদের যাত্রাপালাগুলোতে আইটেম গান প্রদর্শন শুরু হবার পর তা পরিবার পরিজনদের নিয়ে দেখা অসম্ভব হয়ে ওঠে। এতে আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হতে থাকে দর্শক। তাই যাত্রাপালার নামে অশ্লীলতার অভিযোগে কোনো জেলা প্রশাসন যাত্রাপালা অনুমোদন দিতে চায় না। নব্বইয়ের দশকে যাত্রাশিল্পে প্রিন্সেসদের দাপট চলে। এ কারণে শুরু হয় যাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা। শেষমেশ পতন ঘটে এই শিল্পের।

যাত্রা দলগুলো তাদের অস্তিত্বের সংকট কাটাতে এখন বিকল্প ব্যবস্থা নিয়েছে। যাত্রা দলগুলো নাম বদলে দলের নাম রেখেছে ‘লোকনাট্যদল’। যেমন নরসিংদী জেলার কথাই ধরা যাক। সেখানে পুরোনো ও জনপ্রিয় অনেকগুলো যাত্রা দল ছিল। এখন মাত্র আটটি দল আছে। তারা নাম পাল্টে ফেলেছে। অনেকে আবার পরিচালক বা দলপ্রধানের নামেই দলের নাম রেখেছেন। এছাড়া যাত্রা দলগুলোর যে কেবল নাম পরিবর্তন হচ্ছে তা-ই নয়, তাদের মঞ্চায়নের রীতিও বদলে যাচ্ছে।

যাত্রাশিল্পীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল যাত্রাশিল্পীদের জন্য সুদিন। তারপর থেকে আস্তে আস্তে এ শিল্পের প্রতি বাধা নিষেধ আসতে থাকে। এ যাত্রাশিল্পের সঙ্গে বহু লোকের জীবিকাও জড়িত। প্রতিটি দলে শিল্পী, কলাকুশলী মিলিয়ে ৪০ থেকে ৪৫ জন লোক থাকে। পালা মঞ্চস্থ না হওয়ায় এসব মানুষ এখন বেকার।

যাত্রা শিল্পের অবক্ষয় এবং বিলুপ্তির পথে ধাবিত হওয়ার মূল কারণ অসাধু যাত্রাপালা ব্যবসায়ীদের ‘প্রিন্সেস’ আমদানি আর জুয়া-হাউজি চালু । ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। দেশে যেখানে ৩০০-এর বেশি যাত্রা দল ছিল, এখন ৩০টি দলও সংগঠিত হচ্ছে না। প্রায় তিন বছর ধরে যাত্রাপালা বন্ধ।

Related Posts

© 2024 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy