বিশেষ: খুনের প্রমাণ লোপাটে নতুন কৌশল, উদ্বেগ বাড়াচ্ছে সাপ, সরব ভারতের সুপ্রিম কোর্টও

সাপের কামড়ে মৃত্যুর ঘটনা বিশ্বের সর্বত্রই দেখা যায়। তবে বন্দুক ছুরি বা যুদ্ধের বদলে যদি সাপের বিষকেই মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়? শুনে অবাক লাগলেও এই ধরনের ঘটনা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায়শই ঘটে চলেছে। যা নিয়ে সরব হয়েছে সুপ্রিম কোর্টও।
অস্ত্রের আঘাতে কাউকে প্রাণে মারতে চাইলে খুনের প্রমাণ লোপাট হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু শরীরে সাপের কামড়ের দাগ এবং বিষের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেলে তা ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হিসেবেই ধরা হয়। ফলে খুনিরাও পাকড়াও হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায়।

বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, প্রমাণ না রেখে ঠান্ডা মাথায় খুন করার জন্য এর চেয়ে অভিনব পদ্ধতি খুব কমই রয়েছে। তদন্তে জানা যায়, ভারতে এইভাবে খুন করার প্রচলন বেশি। এমনকি,বিভিন্ন আদালতে এ রকম মামলা প্রায়ই আসে, যেখানে বিষধর সাপের কামড়ের মাধ্যমে খুন করার চেষ্টা হয়েছে বলে দাবি করেছেন নিহতের পরিবার।

সম্প্রতি এমনই এক ঘটনা ঘটেছে দেশটি কেরলে। নিজের স্ত্রীকেই সাপের কামড়ে মারার চেষ্টা করেন এক ব্যক্তি। একবার নয়, তিন তিন বার! স্বামী সূর্য কুমারের সঙ্গে উথরার পরিচয় হয় একটি পাত্র-পাত্রীর ওয়েবসাইটে। ঠিক মতো কথা বলতে পারতেন না উথরা। এমনকি, স্বাভাবিকের তুলনায় তার বোধ-বুদ্ধিও ছিল কম। সব জেনেই তাকে বিয়ে করেছিলেন সূর্য।

কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। উথরার পারিবারিক সম্পত্তির দিকেই ছিল সূর্যের নজর। বিয়ের সময় পণ হিসেবে ৭২০ গ্রাম সোনা, একটি গাড়ি ও ৫০ হাজার টাকা নগদ পান। এরপরেও উথরাকে দেখাশোনা করার জন্য তার পরিবারের কাছে প্রচুর অর্থের দাবি করতে থাকেন।

তদন্তে প্রকাশ পায়, প্রতি মাসে আট হাজার টাকা করে পেলেও টাকার প্রতি লোভ ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছিল সূর্যের। বিবাহ বিচ্ছেদের কোনো অজুহাতও খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। শেষে খুন করার ষড়যন্ত্র করতে থাকেন।

নেটমাধ্যমে বিষধর সাপের ব্যাপারে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করার পর তিনি এক সাপুড়ের কাছ থেকে চন্দ্রবোড়া সাপ এনে বাড়ির সিঁড়িতে রেখে দেন। উথরাকে উপর থেকে মোবাইল ফোন আনতে বলেন তিনি।

সূর্য ভেবেছিলেন, সিঁড়িতে সাপের গায়ে পা পড়েই কামড় খেয়ে মৃত্যু হবে তার স্ত্রীর। কিন্তু তার আগেই উথরা সাপটি দেখতে পান। ফলে সে যাত্রায় বেঁচে যান তিনি। তবুও হাল ছাড়েন না উথরার স্বামী। এর কয়েক মাস পরই বিছানার ওপর আবার বিষধর চন্দ্রবোড়া সাপ ছেড়ে ঘুমের মধ্যেই উথরাকে মারার চেষ্টা করেন সূর্য।

৫২ দিন হাসপাতালে ভর্তি থেকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন উথরা। বাড়িতে নিয়ে আসার পর শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এই অবস্থায় উথরাকে ফলের রসের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে দিয়েছিলেন। উথরা ঘুমিয়ে পড়লে বিছানার উপর ছেড়ে দেন কেউটে সাপ। মৃত্যু নিশ্চিত করতে সাপের মাথা ধরে পরপর দুবার বিষদাঁত বসিয়ে দেন উথরার বাঁ হাতে।

কামড়ের দুটো দাগ দেখে সন্দেহ জাগে তদন্তকারীদের। সর্পবিশারদদের মতে, কোনো সাপ দুবার কামড় দিয়ে বিষ নষ্ট করতে চায় না। তা ছাড়া, প্রথম কামড়ের পরেই যন্ত্রণায় উথরার ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা।

তদন্ত আরো জানা যায়, এ কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। উথরাকে খুন করা হয়েছে। সাপুড়ের খোঁজ পাওয়া গেলে পুরো ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে। এরপর সূর্যের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

২০১৯ সালে এমনই আরেক ঘটনা ঘটে রাজস্থানে। জয়পুরের বাসিন্দা আলপনা সাপের কামড়েই মেরে ফেলেন তার শাশুড়িকে। আলপনা তার শাশুড়ির সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতেন। দুজনের স্বামী কর্মসূত্রে বাইরে থাকতেন।

অভিযোগ ছিল, মণীশ নামে একজনের সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন আল্পনা। তার শাশুড়ি এই বিষয়ে সন্দেহ করলে মণীশ ও আল্পনা দুজন মিলে সুবোধ দেবীকে খুন করার পরিকল্পনা করেন। পরে সাপের বিষদাঁত বসিয়ে সুবোধ দেবীকে খুন করা হয়। ঘটনার দেড় মাস পর আলপনার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সন্দেহের বশে পুলিশের কাছে আল্পনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।

তদন্তে কল রেকর্ডসহ অন্যান্য প্রমাণ প্রকাশ্যে আসে এবং আলপনা, মণীশ ও তাদের এক বন্ধু কৃষ্ণ কুমারকে হেফাজতে রাখা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রমণাসহ অন্য বিচারপতিরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেন, বর্তমানে দোষী সাব্যস্ত না হওয়ার জন্য সাপের বিষ দিয়ে খুন করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে দেশে। এই প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে বলে জানান তারা।

তা হলে কি সাপের বিষই নতুন ‘মারণাস্ত্র’ হিসাবে ব্যবহার করা হবে? সম্প্রতি গোয়েন্দা বিভাগসহ বিচারপতিরাও এই বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy