মুম্বাইয়ের বাসিন্দা পৌলোমী পাটেল জদওয়ানি। এক হাতে সামলাচ্ছেন স্বামী, সংসার, ব্যবসা। রুপক অর্থে হয় সত্যিই তিনি এক হাতে সামলে নিচ্ছেন সব কিছু। মাঝে মাঝে এক হাতেই করছেন স্কাইডাইভ, চালান গাড়ি। নিজের সব কাজ নিজেই করেন।
তবে ৩০ বছর বয়সী পৌলোমীর গল্পটা হতে পারত আর দশজন সাধারণ মেয়ের মতো। পৌলোমীর বয়স যখন ১২ বছর তখনই ঘটে যায় দুর্ঘটনা। যা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। স্কুলের গরমের ছুটিতে পৌলোমী বেড়াতে যান হায়দরাবাদে চাচার বাড়িতে। তিন তলা বাড়ির বারান্দায় বোনেদের সঙ্গে মাছ ধরার ভঙ্গিতে খেলছিল ছোট্ট পৌলোমী। আচমকা বিপত্তি। খেলতে খেলতে বারান্দায় টাঙানো লোহার রড পড়ল পৌলোমীর হাতে। তার পর ওই অবস্থায় সেটি পড়ল পাশ দিয়ে যাওয়া ১১,০০০ ভোল্টের ইলেকট্রিক তারে!
একবার শুধু যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়া। তারপর আর তার কিছু মনে নেই। জ্ঞান যখন ফিরল ছোট্ট মেয়েটি দেখল তার ডান হাতটাই নেই! ১১ হাজার ভোল্টের শক খেয়ে মূর্ছা যাওয়া মেয়েটিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় কেউ ভাবতে পারেননি যে তাকে বাঁচানো যাবে। শরীরের একাধিক জায়গায় চোট। দগদগে পোড়া প্রায় সারা শরীর। ওই অবস্থায় কাছের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় পৌলোমীকে।
পৌলোমীর বেঁচে ফেরায় বিস্মিত হয়েছিল চিকিৎসকরাও। এই রকম ইলেকট্রিক শক খেয়ে কেউ সাধারণ বাঁচেন না। ঘটনাস্থলেই মারা যান। তার শরীরের ৭৫-৮০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। হাসপাতালের আইসিইউতে সারা শরীরে তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে কয়েক সপ্তাহ কাটে। প্রায় এক সপ্তাহ বার্নস ওয়ার্ডে রাখা হয়।
এর মধ্যে ডান হাতে গ্যাংগ্রিন শুরু হয়ে যায় পৌলোমীর। কেটে বাদ দেওয়া হয় ছোট্ট পৌলোমীর ডান হাত। পৌলমীর বাবা মুম্বইয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যান মেয়েকে। তখন পৌলমীর বাঁ পায়ে কোনো চামড়া নেই, ডান হাত পচনশীল। ওই অবস্থায় পৌলোমীকে ভর্তি করানো হয় মুম্বইয়ের একটি হাসপাতালে।
এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে করে হায়দরাবাদ থেকে মুম্বইয়ে আনা হয় পৌলোমীকে। তার পর আট মাসে চারটি হাসপাতালে চিকিৎসা হয় ১২ বছরের মেয়েটির। শরীরে একের পর এক সার্জারি। এভাবে ৪৫টি সার্জারি হয় পৌলোমীর সারা শরীরে। ততদিনে চার হাসপাতাল বদল হয়েছে তার।
বাড়ি এসেও প্রায় ঘরে শুয়ে দিন কাটত পৌলোমীর। তার পর আত্মীয়-স্বজন তাদের দেখতে এসে করুণার দৃষ্টিতে তাকাতেন। মেয়ের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভেবে বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের আসা বন্ধ করে দেন বাবা। ধীরে ধীরে কিছুটা সুস্থ হন পৌলোমী। এক বছর স্কুলে যাননি। তবে স্কুলে ফিরতে শিক্ষকদের অনেক সাহায্য পেয়েছিলেন পৌলোমী। পরের বছর এক জন ‘রাইটার’-এর সাহায্য নিয়ে বার্ষিক পরীক্ষা দেন। বেশ ভালো নম্বরই পেয়েছিলেন।
ওই বছরই প্রস্থেটিক হাত হলো পৌলোমীর। কিন্তু সেই হাতের ওজন এতটা ভারী যে তাকে নিয়ে হাঁটাচলা হয়ে উঠল কষ্টের। তবু ধীরে ধীরে অভ্যাস করলেন। সেই হাতেই শুরু করেন লেখার চেষ্টা। প্রথম প্রথম দীর্ঘ চিঠি লিখতেন পৌলোমী। খুব কষ্ট হত। তবু করতেন। এভাবে একটি বই লিখে ফেলেন তিনি।
অনেকে করুণার চোখে দেখেছে। স্কুল-কলেজে তেমন বন্ধুবান্ধবও হয়নি। সবাই কেমন এড়িয়ে যেতেন। এ সবের মধ্যে শেষ করেছেন এমবিএ-এর পড়াশোনা। কিন্তু একজন ছোট থেকে তার হাত ছাড়েনি। সন্দীপ জটওয়ানির সঙ্গে প্রায় ১৪ বছরের বন্ধুত্ব পৌলোমীর। তার গড়ায় ভালোবাসায়। এরপর পরিণতি বিয়ে। এখন তারা সুখে সংসার করছেন।
১২ বছর বয়সে হাত হারানো, শরীরে একাধিক সার্জারির পরও শুধু ইচ্ছেশক্তির উপর ভর করে সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন পৌলোমী।
পৌলোমী বলেন, ‘আমি জীবনের দু’দিক দেখে ফেলেছি। একটা, সক্ষম অবস্থায় মানুষ কেমন থাকে। অন্যটা, ঠিক উল্টো। শুধু বেঁচে থাকা। আসলে জীবনে প্রতি মুহূর্তে বাধা আসে। কিন্তু সেই বাধা টপকানোতেই বেঁচে থাকার আনন্দ মেলে।’
সূত্র: দ্য বেটার ইন্ডিয়া