ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে পেশাগত জীবনেও আমরা এমন বহু কঠিন অথচ সঠিক সিদ্ধান্তকে এড়িয়ে যাই শুধুমাত্র নিজের প্রতি কঠোর না হতে পারার কারনে। বাস্তবতাকে এড়িয়ে কোনও কাজ বা লক্ষ্যেই পূর্ণ সাফল্য পাওয়া যায় না।
আপনাকে তাই সব সময়ে নিজের প্রতি সৎ ও কঠোর হতে হবে। বাস্তবতার নিরিখে কাজ করতে হবে। বাস্তবকে পরিস্কার ভাবে বোঝার চেষ্টা করতে হবে, এবং অপ্রিয় হলেও সত্যকে স্বীকার করতে হবে।
নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নিজের প্রতি কঠোর হওয়া:
আপনি যখন কোনও ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবেন, আপনাকে প্রায়ই অন্যদের সাথে কঠোর আচরণ করতে হবে।কিন্তু অনেক সময়েই অনেকে এটা পেরে ওঠেন না ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা অন্য কোনও কারনে। এক্ষেত্রে দায়িত্বের চেয়ে ব্যক্তিগত আবেগ বেশি প্রশ্রয় পায়। এসব ক্ষেত্রে অন্যের ওপর কঠোর হওয়ার আগে নিজের ওপর কঠোর হওয়াটা জরুরী।
সম্পর্ক বা আবেগের আগে দায়িত্বকে গুরুত্ব দিতে হবে। আপনি যখন নিজের প্রতি কঠোর হবেন, তখন প্রয়োজনে তা অন্যদের ওপরও প্রয়োগ করতে পারবেন। এবং সঠিক ও কার্যকরী নেতৃত্বের জন্য এটা খুবই জরুরী। দায়িত্বের ক্ষেত্রে কে কি মনে করবে, কে কতটা মন খারাপ করবে – এসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। নিজের ভেতর থেকে যদি সাড়া না আসে, মনকে চুপ করিয়ে রাখতে হবে।অন্যদের নেতৃত্ব দেয়ার আগে, নিজেই নিজেকে নেতৃত্ব দিতে শিখুন।
প্রধানত তিনটি কারনে নেতারা কঠোর হতে পারেন না:
অভিজ্ঞতার অভাব:
অনেক প্রতিষ্ঠানেই উচ্চ পদস্থদের চেয়ে নিন্ম পদস্থরা বেশি অভিজ্ঞ হন। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময়ে নতুন একজন উচ্চ পদস্থ নিজের প্রভাব ফেলতে পারেন না। কারন তাদের মনে ভয় থাকে, হয়তো কোনও ভুল হচ্ছে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, যোগ্যতা দিয়েই আপনি উচ্চ পদে বসেছেন। আপনার যদি মনে হয় আপনার অভিজ্ঞতার অভাব, তাহলে সেই বিষয়ে একটু সময় দিয়ে, পড়াশুনা করে নিজের জ্ঞান বাড়িয়ে নিতে পারেন। এতে করে নিজের প্রভাব বিস্তার করার প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস আপনার মাঝে চলে আসবে।
অন্যরা কি ভাববে, তার ভয়:
যা এখনও ঘটেনি, তা নিয়ে দু:শ্চিন্তা করে অনেকেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পায়। একজন নেতাও সবাইকে খুশি রেখে চলতে পারে না। আপনার কোনও সিদ্ধান্তই শতভাগ মানুষকে খুশি করতে পারবে না। কাজেই কে কি ভাবলো – তা নিয়ে কোনও চিন্তা করবেন না। যুক্তি আর প্রয়োজনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিন। ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠানকে সব সময়ে এগিয়ে রাখুন।
অতীত ভুলের কারনে সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাওয়া:
কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে তাতে অটল থাকার জন্য আত্মবিশ্বাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকের আত্মবিশ্বাসই অতীত কোনও ভুলের কারনে টলে যায়। বর্তমানে কোনও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দোটানায় পড়ে যান। এমন পরিস্থিতিতে মনে রাখবেন, অতীত কখনও ফিরে আসবে না। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে তাকে কাজে লাগান, কিন্তু অতীত যেন আপনাকে থামিয়ে না দেয়। আজকের পরিস্থিতিকে হারিয়ে যাওয়া অতীতের সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না।
দিন শেষে আপনি আপনার প্রতিষ্ঠান এবং এর সাথে জড়িত মানুষগুলোর ভালোর জন্যই কাজ করছেন – এই কথা সব সময়ে মাথায় রাখতে হবে।
আপনি যখন নিজের প্রতি কঠোর হবেন, অন্যদের চ্যালেঞ্জ করা আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে।মানুষকে যখন চ্যালেঞ্জ করা হয়, তখন তারা কাজে মনযোগী হয়। সত্যিকার কাজের মানুষেরা সমস্যার সমাধান করতে পারলে খুশি হয়। আপনার টিমে যদি এমন কেউ থাকে, বাস্তব কারনে যাদের প্রতি কঠোর হলে তারা কষ্ট পায় – সত্যি বলতে, আপনার এদের দরকারই নেই। এমন মানুষেরা আসলে যে কোনও টিম ও প্রতিষ্ঠানের বোঝা। সত্যিকার কাজের মানুষেরা বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন নেতা পছন্দ করে। নরম মানুষকে নয়।
আপনি যদি প্রয়োজনে কঠোর হতে পারেন, তাহলে আপনার টিমের সদস্যরা কষ্ট পাওয়া বা নিরুৎসাহিত হওয়ার বদলে, আপনাকে আরও বেশি সম্মান করবে। যারা করবে না – তাদের বিদায় দিন। এই বিদায় দেয়াটাও কঠিন কাজ। যদি মনে করেন এসব মানুষকে দিয়ে আপনার কাজ হবে না – আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে তাদের বিদায় বলে দিন। সত্যিকার নেতা তারাই যারা এমনিতে দয়ালু হলেও, ন্যায়সঙ্গত প্রয়োজনে নিজের ও অন্যের প্রতি কঠোর হতে পারেন।
তবে এর মানে এই নয় যে আপনি সব সময়ে কাঠখোট্টা হয়ে থাকবেন অথবা অন্যের কোনও কথাই শুনবেন না।সবার কথাই বিবেচনা করুন, পরামর্শ ভালো হলে গ্রহণ করুন। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়া মানে ঢালাও ভাবে সবার সিদ্ধান্ত বাতিল করা নয়। সবার প্রতি সদয় আচরণ করুন। শুধুমাত্র প্রয়োজনের খাতিরেই কঠোর হন। কাউকে না বললেও এমন ভাবে বলুন যেন সে অপমানিত না হয়।যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলুন। কারন বোঝাতে পারলে সবাই খুশি হয়েই আপনার কথা মেনে নেবে। সফল ভাবে নেতৃত্ব দিতে গেলে এটা খুব জরুরী।
আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সাফল্য:
পৃথিবীর বড় বড় সফল ব্যক্তিরা সবাই একটা ব্যাপারে একমত। তা হল, সাফল্যের জন্য শৃঙ্খলার কোনও বিকল্প নেই। ক্লাসের ফার্স্ট বয় এবং লাস্ট বয় এর মাঝে কি মেধার খুব বেশি পার্থক্য আছে? – নেই। মূল পার্থক্যটি হল, ফার্স্ট বয়টি লাস্ট বয়ের চেয়ে বেশি সুশৃঙ্খল। যে সময়ে যেটা করার কথা, সে সেই সময়েই সেটা করে।
পড়ার সময়ে যদি টিভিতে খুব ভাল কোনও প্রোগ্রাম চলতে থাকে, সে পড়া ছেড়ে উঠে এসে টিভি দেখতে বসে যায় না। এমন নয় যে সে বাবা-মায়ের ভয়ে পড়ার টেবিলে বসে থাকে। পড়াশুনার ক্ষেত্রে সাফল্য চায় বলেই সে নিজেকে শাসনের মধ্যে রাখে।
আপনি যদি একজন সফল উদ্যোক্তা হতে চান, তবে সাধারন মানুষের চেয়ে আপনাকে বেশি কাজ করতে হবে। আপনার অন্য বন্ধুরা শুক্রবারে ছুটি কাটালে বা একসাথে আড্ডা দিলে আপনাকে সেই লোভ সামলাতে হবে। হাতে কাজ থাকলে নিজেকে জোর করে বসিয়ে রাখতে হবে। নিজের প্রতি কঠোর হওয়ার মানে, নিজের ওপর বিনিয়োগ করা। একটা সময় পর্যন্ত হয়তো আপনার কষ্ট হবে, কিন্তু পরবর্তীতে অন্যদের চেয়ে নিজেকে আপনি অনেক ভালো অবস্থানে নিয়ে যেতে পারবেন। তখন এইসব কষ্টকে আশীর্বাদ মনে হবে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে আসলে নিজের অজান্তেই আপনি আপনার সেরা ভার্সনে পরিনত হবেন।
তবে বেশিরভাগ মানুষ এভাবে চিন্তা করে না। এর কারন বেশিরভাগ মানুষই নিজের ইচ্ছার কাছে দুর্বল। পৃথিবীর মাত্র ৫% মানুষ অন্য সব মানুষকে নেতৃত্ব দেয়। কারন মাত্র ৫% মানুষ নিজেকে নেতৃত্ব দিতে জানে।
কিভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবেন?:
প্রথমেই আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে, কোন কোন জায়গায় আপনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। অর্থাৎ, আপনার দুর্বলতার জায়গা কোনগুলি।
সবচেয়ে ভাল হয় যদি এগুলোকে তালিকার মত করে লিখে ফেলতে পারেন। দুর্বলতার পাশাপাশি নিজের শক্তির জায়গাগুলোও লিখুন।
হতে পারে আপনি আপনার কোনও বিশেষ আত্মীয় বা কর্মীর যে কোনও কথা মেনে নেন। তার অন্যায় আব্দারও না করতে পারেন না। হয়তো কোনও বিশেষ দলের খেলা থাকলে সব কাজ ফেলে সেই খেলা দেখতে বসে যান। হয়তো কোনও একটি বিশেষ খাবার বা রেস্টুরেন্টে খাওয়ার লোভ সামলাতে পারেন না।
দুর্বলতার জায়গাটি যত ছোটই হোক, লিস্ট করে ফেলুন। এরপর একটা একটা করে সেগুলোর ওপর কাজ করতে শুরু করে দিন। প্রথমে সবচেয়ে সহজ গুলো দিয়ে শুরু করুন। আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য আসলে আত্মনিয়ন্ত্রণের অভ্যাসটাই জরুরী।
ছোট ছোট অভ্যাস পরিবর্তন করতে করতে এক সময়ে বড় অভ্যাস গুলোও সহজে বদলাতে পারবেন।
প্রথম দিকে হয়তো এই প্রক্রিয়াটি আপনার কাছে কঠিন ও অস্বস্তিকর মনে হবে। হয়তো প্রথম কয়েকবার আপনি ব্যর্থ হবেন। কিন্তু আর সব জায়গার মত এখানেও “Practice Makes One Perfect” – কথাটি সত্য। কাজেই, দমে না গিলে প্রাকটিস চালিয়ে যান। একটা সময়ে ব্যাপারটি অনেক সহজ হয়ে যাবে।
কিছু মানুষ হয়তো আপনাকে অপছন্দ করা শুরু করবে। সামনে বা পেছনে আপনাকে একগুঁয়ে ডাকা শুরু করবে, কারন আপনি নিজের দায়িত্বের প্রতি সৎ থেকে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া শুরু করেছেন। কিন্তু আপনি যখন বড় সাফল্য অর্জন করবেন, তখন এই মানুষগুলোই আপনাকে কাছে চাইবে। পরামর্শের জন্য আপনার কাছেই আসবে।
আশপাশে এমন পরিবর্তন ঘটতে থাকলে বুঝবেন আপনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছেন। এই পর্যায়ে কেউ আপনাকে একগুঁয়ে বললে সেটাকে প্রশংসা হিসেবে নেবেন। এর মানে আপনি নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার ও তা বাস্তবায়ন করার মানসিক শক্তি অর্জন করছেন। আপনি কোনও অবস্থাতেই আপোস করছেন না এবং কোনও পরিস্থিতিতেই হাল ছাড়ছেন না। সাফল্যের জন্য এগুলো খুবই জরুরী।
আর্ল নাইটএঙ্গেলের ভাষায়, অনেক টাকা আয় করা বা অনেক উপরের পর্যায়ে যাওয়াটাই সব সময়ে সাফল্য নয়। আপনি যে লক্ষ্য ঠিক করেছেন, সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারাটাই আসলে সাফল্য। আর লক্ষ্যে স্থির থাকার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। সে কারনেই নিজের ওপর কঠোর হওয়ার ব্যাপারে এতটা জোর দেয়া হয়। আপনি যখন নিজের লক্ষ্য সিদ্ধান্তে অটল থাকার গুণ অর্জন করবেন, তখন অন্যরাও আপনার ওপর আস্থা রাখবে। আপনাকে অনুসরন করবে। যোগ্য নেতার সবচেয়ে বড় গুণ তো এটাই।
পরিশিষ্ট:
নেতৃত্ব সবাই দিতে পারে না। সবার নেতৃত্ব মানুষ মেনেও নেয় না। নেতা তারাই হতে পারে যারা মানুষের সাধারন দুর্বলতাকে জয় করতে পারে, অন্যদেরও শক্তিশালী হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে পারে। নিজের নেতৃত্ব নিজের হাতে নেয়ার জন্য নিজের দুর্বলতা খুঁজে বের করুন, এবং এগুলোকে নিজের ভেতর থেকে দূর করুন। নিজের সাথে লড়াই করতে কখনও ভয় পাবেন না। কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া একটি সাহস ও আত্মবিশ্বাস পূর্ণ কাজ। নিজের প্রতি কঠোর হতে পারা উন্নতি, সাফল্য ও নেতৃত্বের পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।এর মানে, আপনি নিজের গৌণ আনন্দ ও আরামের বদলে আপনার লক্ষ্যকে প্রাধান্য দিতে পারছেন। লক্ষ্য পূরণের জন্য শুধু এই একটি গুণ অর্জন করাই যথেষ্ঠ। একজন যোগ্য নেতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারলে, অন্যরাই আগ্রহী হয়ে আপনার সাফল্যের জন্য কাজ করবে।