বিশেষ: অন্তর্বাসে ইটের টুকরো, ব্রিজে ঝুলন্ত দেহ, আজও হয়নি রহস্যের কিনারা

সকালবেলা কাজে যাওয়ার পথে ডাক বিভাগের এক কর্মীর চোখে পড়েছিল ঝুলন্ত দেহটি। লন্ডনের ব্ল্যাকফ্রায়ার্স ব্রিজের নিচে একটি কমলা দড়ির ফাঁসে ঝুলছিল সেটি।
পুলিশি তদন্তে ওই ব্যক্তির পরিচয় খোলসা হতেই শোরগোল পড়ে যায়। এ নিয়ে মামলায় আদালত জানিয়েছিল যে, আত্মহত্যা নয়, খুন করা হয়েছিল ওই ব্যক্তিকে। তবে তিনি যে-সে ব্যক্তি নন। তিনি ইটালিয়ান ব্যাঙ্কার জিয়ান রবার্তো ক্যালভি।

অনেকটা অ্যালফ্রেড হিচককের সিনেমার দৃশ্যের মতোই মনে হতে পারে। তবে স্ট্রাইপড শার্ট, ধূসর স্যুট এবং সাদা ওয়েস্টকোট পরা ক্যালভির ঝুলন্ত দেহে বেশ কয়েকটি বিষয় চোখে পড়ার মতো। জুতো-মোজা পরা থাকলেও ক্যালভির দেহে টাই বা বেল্ট বাঁধা ছিল না। পকেটে ছিল প্রায় ১৩ হাজার ডলার মূল্যের ইটালিয়ান লিরা, অস্ট্রেলীয় শিলিং, সুইস ফ্রাঁ এবং আমেরিকান ডলারের মতো নানা ব্যাঙ্কনোট।

ক্যালভির ঝুলন্ত দেহটির পকেটে ছিল একটি পাসপোর্টও। সেই সঙ্গে ট্রাউজাস ও অন্তর্বাস থেকে পাওয়া যায় প্রায় ১২ পাউন্ডের ইটের টুকরো।

তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন, ৬২ বছরের ক্যালভির পকেট থেকে পাওয়া পাসপোর্টটি ভুয়ো। কেন খুন করা হয়েছিল তাকে? ১৯৮২ সালের ১৯ জুন ওই ঘটনার ৪০ বছর পরেও ব্রিটেনের এই হাই-প্রোফাইল খুনের কিনারা হয়নি।

ইতালির মিলান শহরে ব্র্যাঙ্কো অ্যাব্রোসিয়ানো নামে একটি ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ক্যালভি। ইতালির অন্যতম বড় বেসরকারি ব্যাঙ্কের সর্বেসর্বার আরো একটি পরিচিতি ছিল। অনেকেই তাকে গডস ব্যাঙ্কার নামে ডাকতেন।

ভ্যাটিকান থেকে ইটালির মাফিয়াজগৎ— সবেতেই অনায়াস বিচরণ ছিল ক্যালভির। এবং ওই কারণেই জুটেছিল এই শিরোপা।

১৯ জুন ক্যালভির দেহ পাওয়া যায়। তার সপ্তাহখানেক আগে নাকি মিলান থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, লন্ডনে কী করতে গিয়েছিলেন ক্যালভি?

অনেকের অভিযোগ, ভ্যাটিকান এবং মাফিয়াদের আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিল ব্র্যাঙ্কো অ্যাব্রোসিয়ানো এবং খোদ ক্যালভি। ক্যালভির ব্যাঙ্কের মাধ্যমেই মোটা অঙ্কের অর্থ ঢালত তারা। তার মুনাফায় ফুলেফেঁপে উঠেছিলেন ক্যালভি।

ক্যালভির উত্থানের কাহিনিও বেশ চমক জাগায়। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ব্র্যাঙ্কো অ্যাব্রোসিয়ানোতে কেরানির পদে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এরপর এক সময় ওই ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন ক্যালভি।

১৯৮১ সালে বড়সড় আর্থিক লোকসানের মুখে পড়ে ব্র্যাঙ্কো অ্যাব্রোসিয়ানো। অনেকের দাবি, সে সময় কোটি কোটি পাউন্ড খুইয়ে বসেন ক্যালভি। পরের বছর তিনি ভুয়ো পাসপোর্ট জোগাড় করে লন্ডনে পালিয়ে যান বলে অভিযোগ।

ক্যালভির অস্বাভাবিক মৃত্যুর বহু বছর ধরে তদন্ত চললেও এই রহস্যের কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। তদন্তকারীদের দাবি ছিল, ক্যালভি আত্মহত্যা করেছেন। তবে ঘটনার কিনারা করতে না পারলেও এক সময় কেস ফাইল বন্ধ করে দেওয়া হয়।

পুলিশি তদন্তে হতাশ ক্যালভির পরিবার এবার এক বেসরকারি গোয়েন্দার সাহায্য নেন। ঝুলন্ত দেহ উদ্ধারের প্রায় নয় বছর পর জেফ কাট্‌জ নামে এক গোয়েন্দাকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে নিয়োগ করেন তারা।

তদন্তে নামার পর ফরেন্সিক পরীক্ষা শুরু করেন জেফ। ক্যালভির পকেট ও অন্তর্বাস থেকে ইটের টুকরো পাওয়া গেলেও ইটের গুঁড়ো পাওয়া যায়নি তার হাতে। ইটের টুকরো না ধরে কীভাবে তা পকেটে পুরলেন ক্যালভি? জেফের দাবি, ইটের টুকরোগুলো কেউ নিশ্চয়ই ক্যালভির পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।

গলায় দড়ির ফাঁসের দাগ ছাড়া ক্যালভির ঘাড়েও ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। ব্রিজের যে অংশে তার দেহ ঝুলছিল, সেটি মরচে ধরা এবং রংচটা হলেও ক্যালভির জুতোয় তার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তিনি নিজেই যদি ওই ব্রিজে চড়েন, তা হলে তার জুতো থেকে সেসব চিহ্ন কীভাবে গায়েব হলো? প্রশ্ন তোলেন জেফ।

জেফের তদন্তের পর ২০০৩ সালে আবারো ওই কাণ্ডের ফাইল খুলেছিল লন্ডন পুলিশ। তবে এবার হত্যাকাণ্ড হিসাবে তদন্ত শুরু করে তারা।

ক্যালভিকে খুনের অভিযোগে মামলা রুজু হয়েছিল ইটালিতেও। তাতে পাঁচজন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা চলেছিল। তবে ২০০৭ সালে প্রমাণাভাবে সেই অভিযুক্তদের ছেড়ে দেয় আদালত। যদিও আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, এটি আত্মহত্যা নয়। ক্যালভিকে খুন করা হয়েছিল।

কী কারণে ক্যালভিকে খুন করা হয়েছিল, তা আজও জানা যায়নি। অনেকের দাবি, এতে মাফিয়াদের হাত থাকতে পারে। মাফিয়াদের প্রায় পাঁচ কোটি পাউন্ড নাকি আত্মসাৎ করেছিলেন ক্যালভি। ভারতীয় মুদ্রায় যার মূল্য প্রায় ৪৭৬ কোটি টাকা।

জীবদ্দশায় ‘পি২ মেসোনিক’ নামে একটি বেআইনি সংগঠনের সদস্য ছিলেন ক্যালভি। ঘটনাচক্রে, ওই সংগঠনের সদস্যেরা ইটালিতে ‘ফ্রাটি নেরি’ নামে পরিচিত। যা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ব্ল্যাক ফ্রায়ার্স— যে ব্রিজে ঝুলছিল ক্যালভির দেহ!

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy