সব কিছু পরিকল্পনা মাফিক চললে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে ফিরছেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। ক্ষমতাসীনদলের প্রধান ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে তার এ বিষয়ে আলোচনা একেবারে চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছেছে। ধারণা করা হচ্ছে শেষ মুহূর্তে কোনো নাটকীয় পট পরিবর্তন না হলে বিজেপির সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক চুকিয়ে শোভন ফিরতে চলেছেন তৃণমূলেই।
এই জল্পনার মধ্যেই শোভন ও তার বান্ধবী বৈশাখী বুধবার দুপুরে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন। সেখানেই শোভনের তৃণমূলে ফেরার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে। একইসঙ্গে সিদ্ধান্ত হতে পারে বৈশাখীর তৃণমূলে যোগদান নিয়েও।
তৃণমূলের একটি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, একসঙ্গেই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছিলেন শোভন-বৈশাখী। ফিরলেও একসঙ্গে ফিরবেন। সে ক্ষেত্রে বৈশাখীকে দলের কাজে কী ভাবে লাগানো যায়, তা নিয়েও চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে।
ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাপড়েনের জেরে শোভন তৃণমূল ছেড়েছিলেন বলেই প্রচলিত। তার সঙ্গে তৃণমূলের কখনোই কোনো ‘রাজনৈতিক দূরত্ব’ সে ভাবে তৈরি হয়নি। দলের পাশাপাশিই শোভন ছেড়েছিলেন কলকাতার মেয়রের পদ ও রাজ্যের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে মন্ত্রীত্ব। পরে তিনি বেহালা পূর্বের বিধায়ক পদটিও আর ধরে রাখেননি। ২০২১ সালের ভোটে তিনি তার পুরোনো কেন্দ্র থেকে ভোটে লড়েননি। সেখান থেকে তৃণমূল টিকিট দিয়েছিল শোভনের স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায়কে। তিনি আসনটি জিতে অধুনা বেহালা পূর্বের সংসদ সদস্য।
তৃণমূল ছাড়ার পর শোভনের তৎকালীন ‘স্বাভাবিক গন্তব্য’ ছিল বিজেপি। বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি গেরুয়া শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু বিজেপির সঙ্গে শোভনের সম্পর্ক কখনোই খুব ‘মসৃণ’ ছিল না। বার বারই তার ও বৈশাখীর সঙ্গে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের মনোমালিন্য হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে তাদের নামে অভিযোগও করা হয়েছিল। কিন্তু মূলত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হস্তক্ষেপেই তারা তখনকার মতো বিজেপিতে রয়ে গিয়েছিলেন।
তবে দ্বন্দ্ব ও মন কষাকষি কমেনি। যার জেরে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের প্রক্রিয়া থেকে খানিকটা দূরেই ছিলেন শোভন-বৈশাখী। ভোটে বিজেপির বিপর্যয়ের পর সেই দূরত্ব আরও বাড়ে। বস্তুত, ‘সক্রিয় রাজনীতি’ থেকেও দূরত্ব বেড়েছিল শোভনের।
বিধানসভা ভোটে বিজেপির বিপর্যয়ের পর ভোটের অনেক আগে বা অব্যবহিত আগে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়া বেশ কয়েক জন নেতা আবার ঘরে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে যেমন আছেন অধুনা-প্রবীণ মুকুল রায়, তেমনই আছেন রাজ্যের মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও সব্যসাচী দত্ত।
অন্যদিকে বিজেপি থেকে তৃণমূলে এসেছেন সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। কিন্তু শোভনের কথা সেভাবে কখনোই আলোচিতই হয়নি। তৃণমূলের শীর্ষনেতাদের অধিকাংশই মনে করে নিয়েছিলেন, শোভন সক্রিয় রাজনীতি থেকে কার্যত সরেই গিয়েছেন। সেই পরিস্থিতিতেই ময়দানে নামেন স্বয়ং মমতা।
শোভনের ঘনিষ্ঠদের দাবি, দল বা মন্ত্রিত্ব ছাড়লেও মমতার সঙ্গে শোভনের একটা স্নেহের সম্পর্ক বরাবরই বজায় থেকেছে। ভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরে থাকলেও মমতা-শোভনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কমেনি।
সেই সূত্রেই শোভনের তৃণমূলে ফেরা নিয়ে আলাপ-আলোচনার শুরু হয়েছিল বলে জানা গেছে। সক্রিয় রাজনীতিতে না থাকলেও শোভন নিয়মিত রাজনীতির খোঁজখবর রাখেন। ঘনিষ্ঠমহলে বিভিন্ন বিষয়ে তার মতামতও প্রকাশ করেন। তবে তিনি কখনোই সেভাবে শাসক তৃণমূল সম্পর্কে কোনো খারপ মন্তব্য করেননি।
এই পরিস্থিতিতে শোভন তৃণমূলে ফিরলে কী হিসেবে ফিরবেন, সেটিও প্রণিধানযোগ্য প্রশ্ন। শাসক দলের একটি সূত্রের দাবি, শোভনকে প্রয়াত সাধন পান্ডের মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রে উপ-নির্বাচনে প্রার্থী করতে পারেন মমতা।
তবে তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, শোভন তৃণমূলে ফিরলেও মমতা এখনই তাকে বিধায়ক বা ওই ধরনের কোনও জনপ্রতিনিধিত্ব মূলক পরিসরে না-ও জায়গা দিতে পারেন। আপাতত তাকে দলে কোনো পদ দেওয়া হতে পারে। ভবিষ্যতে শোভনকে পৌরসভা, বিধানসভায় দাঁড় করানোর কথা ভাবতে পারেন মমতা। তবে তৃণমূলের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ একটি বিষয়ে নিশ্চিত যে মমতা শোভনকে রাজ্যের রাজনীতিতেই রাখতে চান। জাতীয় রাজনীতিতে নয়।
অন্যদিকে শোভনের প্রত্যাবর্তনে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের একটা অংশ উচ্ছ্বসিত ও আশ্বস্তই হবেন বলে মনে করছেন দলের শীর্ষনেতারা। শোভন নিজে দীর্ঘ দিন ধরে রাজনীতি করেছেন। কলকাতার মেয়র ও রাজ্যের মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ এর ভূমিকাও পালন করেছেন। মমতাও বিভিন্ন সময়ে তার ওপর নির্ভর করেছেন। ফলে শোভনের প্রত্যাবর্তনে তৃণমূলের লাভই দেখতে পাচ্ছেন দলের নেতা-কর্মীদের একাংশ।