
সুদানের রাজধানী খার্তুমে অবস্থিত প্রেসিডেন্ট প্যালেস পুনরুদ্ধার করেছে সুদানের সেনাবাহিনী। শুক্রবার ভোরে এই অভিযানের পর সেনাবাহিনী ও তাদের সমর্থকরা সারাদেশে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। প্রায় দুই বছর ধরে আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের (আরএসএফ) দখলে থাকা এই প্রাসাদ পুনরুদ্ধারকে সেনাবাহিনীর একটি প্রতীকী জয় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে আরএসএফের বিরুদ্ধে বড় ধরনের পাল্টা আক্রমণ শুরু করে সুদানের সেনাবাহিনী। ২০২৩ সালের এপ্রিলে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত যুদ্ধে আরএসএফ খার্তুমের বেশিরভাগ এলাকা ও প্রেসিডেন্ট প্যালেস দখল করে নিয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে একের পর এক এলাকা পুনরুদ্ধার করে এগিয়ে চলেছে। শুক্রবারের এই সাফল্য সেনাবাহিনীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
অভিযান ও চলমান সংঘর্ষ
সেনাবাহিনী বর্তমানে প্রেসিডেন্ট প্যালেসের আশপাশে আরএসএফ সদস্যদের খুঁজে বের করতে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম রয়টার্স জানিয়েছে, খার্তুমের কেন্দ্রীয় এলাকাগুলোতে এখনো থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এটি ইঙ্গিত করে যে রাজধানীতে সংঘর্ষ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। আরএসএফের একটি বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, তাদের যোদ্ধারা এখনো এলাকার আশপাশে রয়েছে এবং তারা লড়াই চালিয়ে যাবে।
মানবিক সংকটের ছায়া
জাতিসংঘের মতে, সুদানের সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে এই সংঘাত বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে। যুদ্ধের ফলে প্রায় ১২ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং একাধিক অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের শিশু তহবিলের প্রধান এই সংঘাতকে বিশ্বের বৃহত্তম শিশু-বিপর্যয় হিসেবে অভিহিত করেছেন। খাদ্য, পানি ও চিকিৎসার অভাবে লাখো মানুষ মৃত্যুর মুখে পড়েছে।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ
সংঘাতে অংশ নেওয়া উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। আরএসএফের বিরুদ্ধে গণহত্যা, লুটপাট ও যৌন সহিংসতার অভিযোগ রয়েছে, যদিও তারা এগুলো অস্বীকার করেছে। অন্যদিকে, সেনাবাহিনীও বেসামরিক এলাকায় নির্বিচারে বোমা হামলা ও সংক্ষিপ্ত বিচারে হত্যার জন্য সমালোচিত হয়েছে। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উভয় পক্ষই এই অভিযোগগুলো প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের অবস্থানকে ন্যায্য বলে দাবি করে আসছে।
প্রতীকী জয়, তবে যুদ্ধ অব্যাহত
প্রেসিডেন্ট প্যালেস পুনরুদ্ধার সেনাবাহিনীর জন্য একটি বড় মনোবল বৃদ্ধিকারী ঘটনা। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, সেনারা প্যালেসের ভেতরে উল্লাস করছে এবং জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি যুদ্ধের সমাপ্তি নয়। আরএসএফ এখনো পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুরে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে এবং একটি সমান্তরাল সরকার গঠনের চেষ্টা করছে। এই পরিস্থিতি সুদানকে একটি বিভক্ত রাষ্ট্রের দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।
সুদানের এই সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালে দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক ওমর আল-বশিরের পতনের পর। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং আরএসএফ নেতা মোহাম্মদ হামদান দাগালো (হেমেদতি) প্রথমে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রতিশ্রুতি দিলেও ২০২১ সালে যৌথভাবে একটি অভ্যুত্থান ঘটান। পরবর্তীতে ক্ষমতা ভাগাভাগি ও আরএসএফকে সেনাবাহিনীতে একীভূত করার প্রশ্নে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়, যা ২০২৩ সালে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয়।
প্রেসিডেন্ট প্যালেস পুনরুদ্ধারের এই ঘটনা সুদানের চলমান সংকটে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলেও, শান্তির সম্ভাবনা এখনো অনিশ্চিত। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও, উভয় পক্ষই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিতে অটল।
সূত্র: আল-জাজিরা, রয়টার্স