কিউবার রাজধানী হাভানার বাসিন্দা এলিসা বেসিয়ান। শহরটির ধসে পড়ার ঝুঁকিতে যে প্রায় ৭০০ ভবন রয়েছে, তারই একটিতে থাকেন তিনি। এলিসা বলেন, ‘আমরা যখন ঘুমাতে যাই, তখন এই ভয়ে থাকি যে আঘাত পেয়ে যেন জেগে না উঠি।’
এলিসার বয়স ৫১ বছর। তিনি তার ১২ বছরের মেয়ে লেসিয়ানিসকে নিয়ে হাভানার একটি পুরোনো ভবনে বসবাস করেন। ‘এডিফিসিও কিউবা’ নামের ওই ভবন ১৯৪০ সালে নির্মিত।
কমিউনিস্টশাসিত কিউবার বেশির ভাগ বাড়ির মতো এলিসাদের ছয়তলা ভবনটিও রাষ্ট্রমালিকানাধীন। মোট ১১৪ কক্ষের ওই ভবনে বিনা ভাড়ায় ৯২টি পরিবার বসবাস করে।
ভবনের বাসিন্দারা বলছেন, একসময় ভবনটি বিলাসবহুল হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু এখন মেঝের তক্তাগুলো জায়গায় জায়গায় ভেঙে গেছে। ছাদ, দেয়াল ও চলাচলের পথের দেয়ালে ফাটল ধরে ভেতরের ধাতব কাঠামো দেখা যায়। চারপাশ ভাঙা আর ফুটো।
এলিসা বেসিয়ান জানান, শিশুরা এখানে খেলতে পর্যন্ত পারে না। কারণ, যেকোনো সময় পলেস্তারা, নয়তো কংক্রিট খসে খসে পড়ে। এ কথা বলার সময় তার চোখে জল দেখা যায়।
এলিসা বেসিয়ান বলেন, ‘ইতিমধ্যে এক সন্তান হারিয়েছি। এখন মেয়েকেও হারাতে চাই না।’
দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণ করার অভাবে প্রায়ই হাভানার এসব ভবন পুরো, নয়তো আংশিক ধসে পড়ে। বিশেষ করে জুন থেকে নভেম্বরে বৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ভবনধসের ঘটনা বেশি ঘটে। ২০২০ সালে একটি ভবনের বারান্দা ধসে পড়ে তিন তরুণী প্রাণ হারান।
কিউবার রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, এ বছর জুনের প্রথমে বৃষ্টিপাতে হাভানার ১৪৬টি ভবন আংশিক ধসে পড়েছে। পুরো ধসে গেছে আরো দুটি। এতে ৬৯ বছর বয়সী এক ব্যক্তি প্রাণ হারান। এরপর কে ভবনধসের শিকার হবে, সেটা কেউ জানে না।
সরকারের দেওয়া হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালের শেষ নাগাদ কিউবায় দেশজুড়ে প্রায় ৩৯ লাখ আবাসিক ভবনের মধ্যে ৩৭ শতাংশ ভবনই ধসে পড়ার মতো ঝুঁকিতে ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভবন নির্মাণ বিশেষজ্ঞ এএফপিকে বলেন, এলিসাদের এডিফিসিও কিউবার মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত অবকাঠামোগত অসংখ্য ত্রুটি দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘সেখানে মানুষের বসবাসের কোনো অনুমোদনও নেই।
অন্য ভবনগুলোর মতো এই ভবনতেও অস্থায়ীভাবে সিঁড়ি, শৌচাগার ও জল রাখার পাত্র তৈরি করা হয়েছে। এতে ভবনগুলোর ওজনের সঙ্গে সঙ্গে ধসে পড়ার ঝুঁকি বেড়েছে।
১৯৯৭ সালে এডিফিসিও কিউবায় স্থানান্তরিত হন ৫৭ বছর বয়সী ক্যারি সুয়ারেজ। এর আগে তিনি যে ভবনে ছিলেন, সেটি ধসে পড়ার ঝুঁকির তালিকায় ছিল। একদিন ভবনটি ধসে পড়ে। ক্যারি তখন বাড়ির বাইরে ছিলেন। সন্তানদের স্কুলে পৌঁছে দিচ্ছিলেন। কিন্তু ভবনধসের সময় ক্যারির মা ঘরে ছিলেন। ভবনধসে ক্যারির মা সেদিন প্রাণ হারান। এরপর আবাস বদল করেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি যে ভবনে রয়েছেন, সেটিও ধসে পড়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।
ক্যারি বলেন, ‘এভাবে বেঁচে থাকা এবং পতনের দ্বারপ্রান্তে শঙ্কা নিয়ে থাকাটা খুব কঠিন।’
তিনি বলেন, ‘এখানে আমরা সবাই পরিশ্রান্ত, কিন্তু কারও কোনো সাড়া পাইনি।’
পেনা জানান, মধ্যরাতে যদি হঠাৎ ঘর ছাড়তে হয়, এ জন্য ভারী পোশাক পরে ঘুমান তিনি। তিনি বলেন, একবার নয়, এ রকম অনেকবার হয়েছে তার সঙ্গে। এমনও হয়েছে যে মধ্যরাতে হঠাৎ সন্দেহজনক শব্দ শুনে বাসিন্দারা বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন।
এডিফিসিও কিউবার বাসিন্দা সমাজকর্মী লুভিয়া দিয়াজ (৫০)। ভবনটির ছয়তলায় সঙ্গী, তিন মেয়ে, এক নাতিসহ থাকেন তিনি। লুভিয়া বলেন, ‘আমার চোখের চারপাশে কালো দাগ পড়েছে। আমি ঘুমাতে পারি না। মনে হয়, কখন না ভবনের অংশ ধসে পড়বে।’
চলতি মাসের শুরুতে বৃষ্টিতে লুভিয়া যে ঘরে থাকেন, তার ছাদের অংশবিশেষ ধসে পড়ে। অবশ্য এ সময় বিছানায় কেউ ছিল না। লুভিয়া বলেন, ‘আমার মেয়ে সেখান ঘুমায়। ছাদ ধসে পড়ার সময় যদি সে সেখানে, থাকত তাহলে হয়তো মর্মান্তিক একটা ঘটে যেতে পারত।
নিজেকে পুম্মা নামে পরিচয় দেওয়া অপর এক বাসিন্দা বলছেন, শৈশবেই এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন তিনি। ২৯ বছর আগে যখন তার বয়স দুই বছর, তখন ভবনের একটি অংশ ধসে পড়েছিল। ভবনধসের ওই ঘটনার সময় সেখানে ছিলেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
পুম্মা বলেন, ছাদের একটি অংশ এসে তার মাথায় আঘাত করেছিল। এতে গুরুতর আহত হন তিনি। কপালে জটিল একটি সার্জারি করতে হয়েছিল তার। ঘর পরিষ্কার করতে করতে তিনি বলেন, ‘এখানে থাকতে ভয় করছে আমার। দ্বিতীয়বার এমনটা হলে হয়তো বাঁচব না।’