
পশ্চিমবঙ্গের নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় প্রায় দু’বছর জেলে কাটানোর পর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন বহিষ্কৃত যুব তৃণমূল কংগ্রেস নেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার একটি বিশেষ আদালত তাঁকে ১ লক্ষ টাকার বন্ড ও একাধিক শর্তসাপেক্ষে জামিন মঞ্জুর করে। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে হুগলি জেলার বলাগড়ে ফিরতেই শান্তনুকে বীরের সম্মানে সংবর্ধনা জানানো হয়। আরতি, শাঁখধ্বনি আর উলুধ্বনির মধ্যে তাঁকে বরণ করে নেওয়া হয়। আশ্চর্যজনকভাবে, দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়া সত্ত্বেও এই সংবর্ধনায় উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের কয়েকজন পঞ্চায়েত সদস্য।
২০২৩ সালের মার্চে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) শান্তনুকে গ্রেফতার করে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় ১.৩৯ কোটি টাকা কমিশন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং সেই টাকা একাধিক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে মানি লন্ডারিংয়ে জড়িত ছিলেন। গ্রেফতারির পর তৃণমূল কংগ্রেস তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করে। তবে জেল থেকে মুক্তির পর শান্তনু দলের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, “বহিষ্কারের বদলে দল আমাকে সাসপেন্ড করতে পারত। জেলে থাকাকালীন অনেক কিছু জেনেছি। দলের একাংশের চক্রান্তের কথা জানি। এবার সব জানাব নেতৃত্বকে।”
বীরের সংবর্ধনায় চমক
জেলমুক্তির পর বলাগড়ে ফিরতেই শান্তনুর জন্য আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় তৃণমূলের কয়েকজন পঞ্চায়েত সদস্য। দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের উপস্থিতি রাজনৈতিক মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। শান্তনুকে ফুলের মালা পরিয়ে, আরতি করে এবং শাঁখ বাজিয়ে বরণ করা হয়। এই ঘটনা দলের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
দলের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ
জেল থেকে ফিরেই শান্তনু তৃণমূলের একাংশের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেন, “আমার বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে, তা পুরোপুরি দলের কিছু নেতার ষড়যন্ত্র। জেলে থাকার সময় অনেক তথ্য আমার কাছে এসেছে। আমি এবার দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে সব খুলে বলব।” তিনি আরও দাবি করেন, তাঁকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে নেওয়া হয়েছে। “দল আমাকে সাসপেন্ড করে তদন্তের অপেক্ষা করতে পারত। কিন্তু সরাসরি বহিষ্কার করে আমার ওপর অন্যায় করা হয়েছে,” বলেন শান্তনু।
আইনি লড়াই ও জামিন
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় শান্তনুকে গ্রেফতারের পর ইডি দাবি করেছিল, তিনি শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অন্যতম মধ্যস্থতাকারী ছিলেন। তাঁর বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছিল ৩৪৬ জন প্রার্থীর একটি তালিকা, যাঁরা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চাকরি পেয়েছিলেন বলে অভিযোগ। ২০২৪ সালের নভেম্বরে কলকাতা হাইকোর্ট তাঁকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয়। তবে সিবিআইয়ের একটি সমান্তরাল মামলায় জামিন না পাওয়ায় তিনি জেলেই ছিলেন। অবশেষে বৃহস্পতিবার একটি বিশেষ আদালত তাঁকে ১ লক্ষ টাকার বন্ডে জামিন দেয়। জামিনের শর্ত হিসেবে তাঁর চলাচল হুগলি ও পার্শ্ববর্তী তিনটি জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, তদন্তকারীদের ডাকলে হাজির হতে হবে এবং তাঁর মোবাইল নম্বর অপরিবর্তিত রাখতে হবে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
শান্তনুর জেলমুক্তি ও তাঁর বিস্ফোরক মন্তব্য তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দলের একাংশ তাঁর সংবর্ধনাকে সমর্থন করলেও, শীর্ষ নেতৃত্ব এখনও এ বিষয়ে নীরব। তৃণমূলের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “শান্তনুর কথায় দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসতে পারে। তবে তিনি যদি নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ জানান, তা তদন্ত করে দেখা হবে।” অন্যদিকে, বিরোধীরা এই ঘটনাকে তৃণমূলের দুর্নীতির প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরছেন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, “দল থেকে বহিষ্কার করলেও তৃণমূলের নেতারা শান্তনুকে সমর্থন করছেন। এটাই তাদের দ্বিচারিতা।”
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জেলমুক্তি ও তাঁর অভিযোগ আগামী দিনে তৃণমূলের রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে, তা এখন সময়ের অপেক্ষা।