চিয়াংশি প্রদেশ চীনের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত। ভৌগোলিকভাবে এর অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু, বৃষ্টিপাত ও চারটি স্বতন্ত্র ঋতুসহ উপক্রান্তীয় আর্দ্র মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত একটি প্রদেশ চিয়াংশি। এর পূর্বে ঝেচিয়াং ও ফুজিয়ান প্রদেশ, দক্ষিণে গুয়াংতং, পশ্চিমে হুনান, উত্তরে হুবেই ও আনহুই প্রদেশের সীমানা রয়েছে।
উত্তরে ইয়াংজি নদীর তীর ঘেঁষে দক্ষিণ ও পূর্বে পাহাড়ি এলাকায় বিস্তৃত প্রদেশটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জল ও তাপমাত্রা রয়েছে। শীতকালে উষ্ণ ও গ্রীষ্মকালে গরম থাকে। বার্ষিক গড় তাপমাত্রা প্রায় ১৬.৩ থেকে ১৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১৩৪১ থেকে ১৯৪৩ মিলিমিটার, বার্ষিক রোদের সময় ১৬০০ থেকে ২১০০ ঘণ্টা ও ২৪০ থেকে ৩০৭ দিন পর্যন্ত হিমমুক্ত সময়কাল।
প্রদেশটির শহরে কিংবা গ্রামীণ এলাকায় কর্পূর গাছের বৃদ্ধির জন্য খুবই উপযুক্ত। কারণ কর্পূর গাছ উষ্ণতা ও আর্দ্রতা পছন্দ করে, ঠান্ডা প্রতিরোধী নয়। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সাহিত্যিক ঐতিহ্যের দ্বৈত প্রভাবের অধীনে, উন্নত শিকড়সহ কর্পূর গাছগুলো প্রাচীনকাল থেকেই চিয়াংশিতে রয়েছে।
প্রদেশটির উন্নত পরিবেশগত অবস্থা, কর্পূর গাছ রোপণ ও রক্ষা করার সূক্ষ্ম ঐতিহ্য কর্পূর গাছের ‘দীর্ঘায়ু’ বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এমনকি চিয়াংশিতে হাজার হাজার বছরের পুরোনো প্রাচীন কর্পূর বন রয়েছে যা প্রদেশটির প্রাচীনকালের সংস্কৃতিকে প্রকাশ করে।
চিয়াংশি প্রদেশটির ৬৩.১ শতাংশ বনাঞ্চালসহ চীনের ‘সবুজ প্রদেশগুলোর মধ্যে একটি’ হিসাবে পরিচিত। আর প্রদেশটির বনভূমির মধ্যে কর্পূর গাছটি সবচেয়ে স্বতন্ত্র চিরহরিৎ গাছের প্রজাতি। চিরহরিৎ রঙ সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য বহন করে।
চিয়াংশি প্রদেশের প্রাদেশিক গাছ হচ্ছে কর্পূর গাছ। একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘কর্পূর গাছ ছাড়া কোনো গ্রাম নেই’ ও কর্পূর গাছ ছাড়া কোনো গ্রাম হতেই পারে না’। আসলে, কর্পূর গাছ চিয়াংশি প্রদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ১৯৮০ এর দশকে অদম্য প্রকৃতির কারণে এটি চিয়াংশির ‘প্রাদেশিক গাছ’ হিসাবে পরিচিতি পায়।
শক্তিশালী জীবনীশক্তির সঙ্গে কর্পূর গাছটি সৌভাগ্য, দীর্ঘায়ু, সুখ ও সম্প্রীতির প্রতীক হিসাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কর্পূর গাছের কোনো অংশই নষ্ট হয় না। কর্পূর গাছের ডালপালা, পাতা, বীজ ও কাঠের এক অনন্য গন্ধ রয়েছে।
চিয়াংশি একাডেমি অব ফরেস্ট্রির জাতীয় বনায়ন ও ঘাস ব্যুরোর কর্পূর ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি গবেষণা কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুসারে, চিয়াংশি প্রদেশে ৩০০টিরও বেশি প্রাচীন কর্পূরের বন রয়েছে। এই প্রাচীন কর্পূর বনগুলো তাদের অনন্য পরিবেশগত, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, মানবতাবাদী ও পর্যটন মূল্যবোধের জন্য মানুষের কাছে ক্রমবর্ধমান মূল্যবান বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
আনফু কাউন্টি, চিয়াংশি প্রদেশের ১৮টি প্রাচীন সভ্য কাউন্টির মধ্যে একটি, ‘মধ্য চিয়াংশির আশীর্বাদপূর্ণ ভূমি’ হিসাবে পরিচিত। এই কাউন্টিটি লুঅশিয়াও পর্বতমালার মাঝখানে অবস্থিত, একটি হালকা জলবায়ু, পর্যাপ্ত সূর্যালোক ও দীর্ঘ সময় ধরে তুষারমুক্তসহ তিন দিকে পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত এটি চিরহরিৎ গাছ যেমন কর্পূর গাছের বৃদ্ধির জন্য খুবই উপযোগী।
সামগ্রিকভাবে, আনফু কাউন্টিতে কর্পূর গাছের বিস্তৃত বণ্টন, বড় সংখ্যা, অদ্ভুত গাছের আকৃতি, ভিন্ন আচার-আচরণ, দীর্ঘ বয়স ও গভীর ঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ২০১৭ সালে আনফু কাউন্টিকে চাইনিজ ফরেস্ট্রি সোসাইটি কর্তৃক ‘চীনে কর্পূর গাছের হোমটাউন’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়, যা দেশটির কর্পূর গাছের একটি সত্য শহর হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
পরিসংখ্যান অনুসারে, আনফু কাউন্টিতে ১২০,০০০ এর বেশি কর্পূর গাছ রয়েছে যার মধ্যে ৪০০ বছরের বেশি বয়সের ১০,০০০ এর বেশি প্রাচীন কর্পূর গাছ ও ১০০০ এর বছরের বেশি বয়সের ২০০টিরও বেশি প্রাচীন কর্পূর গাছ রয়েছে।
আনফু কাউন্টির কর্পূর গাছের একটি দীর্ঘ ইতিহাস ও গভীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। এই কাউন্টির মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে কর্পূর গাছকে লালন করার ঐতিহ্য রয়েছে। অনেক জায়গাই ‘কর্পূর’ নামটি তারা ব্যবহার করে থাকে। স্থানের নামের আদমশুমারিতে দেখা গেছে, কাউন্টিতে ‘কর্পূর’ শব্দটিসহ ১০০টিরও বেশি গ্রাম রয়েছে। কাউন্টিতে অসংখ্য রাস্তা, পাহাড়, নদী, সেতু, পুল, উপসাগর ইত্যাদির নামকরণ করা হয়েছে ‘কর্পূর’ গাছের নামানুসারে।
আনফু কাউন্টির গ্রামগুলোতে অনেক প্রাচীন কর্পূর গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গ্রামগুলোতে গাছের রঙিন ছায়া ঘোরাফেরা করে। একটি গাছ একটি দৃশ্য ও একটি প্রাচীন কর্পূর গাছের একটি গল্প আছে। স্থানীয় লোকেরা প্রায়শই নৃতাত্ত্বিক কৌশল ব্যবহার করে কর্পূর গাছের নাম তাদের বৈশিষ্ট্য, চেহারা ও কর্পূর গাছের ইঙ্গিত অনুসারে করে থাকে। আনফু কাউন্টির স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাসের তিনটি প্রধান কাজ হলো রাস্তা তৈরি করা, ব্রিজ তৈরি করা ও কর্পূর গাছ লাগানো।
কর্পূর গাছকে দেবতা রূপে ভক্তিভরে পূজা করার প্রথাও রয়েছে এখানকার স্থানীয় মানুষের মধ্যে। প্রতি বছর প্রথম চীনা চন্দ্র মাসের ১৫ তারিখে গ্রামের প্রবীণরা গ্রামবাসীদের নিয়ে প্রাচীন কর্পূর গাছের নিচে বিভিন্ন কাজকর্মের জন্য নেতৃত্ব দেন। তারা কর্পূর গাছের কাছে মাথানত করেন ও কর্পূর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা পাঠান। ভালো আবহাওয়া, প্রচুর ফসল, সমৃদ্ধি ও গ্রামবাসীদের সুস্বাস্থ্যসহ কর্পূর ঈশ্বরের কাছে গ্রামটিকে আশীর্বাদ করার জন্য অনুরোধ করেন।
‘পাঁচ-পাঞ্জা কর্পূর’ গাছটি হান রাজবংশের একটি প্রাচীন কর্পূর গাছ ও প্রাচীন সভ্যতা থেকে আনফু কাউন্টির প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত। এই ‘পাঁচ-পাঞ্জা কর্পূর’ গাছটি ২০০০ বছরেরও বেশি পুরোনো ও চিয়াংশি প্রদেশের সবচেয়ে ‘দীর্ঘজীবী’ কর্পূর গাছ। ২০১৯ সালে এটি ‘চিয়াংশি কর্পূর গাছের রাজা’ নামকরণ করা হয়েছিল। এই গাছের উচ্চতা ৩৫ মিটার, কাণ্ডের পরিধি ১৩.৯ মিটার ও চূড়ার এলাকা প্রায় ২৪০০ বর্গ মিটার।
গাছটি মাটি থেকে প্রায় ৫ মিটার দূরে হতে শাখা শুরু হয়। ড্রাগন দ্বারা প্রসারিত পাঁচটি বিশাল শাখা কাণ্ড ধরে রাখার জন্য পাঁচটি নখের মতো দেখতে। তাই স্থানীয় লোকেরা এটিকে ‘পাঁচ-পাঞ্জা কর্পূর’ বলে ডাকে যা ‘কুইশো কর্পূর’ নামেও পরিচিত। যদিও এর কাণ্ড খালি ও পচা। তারপরও একটি চমৎকার গাছের আকৃতিতে সূর্যের ছায়ায় দেখতে একটি ছাতার মতো মনে হয়।
আনফু কাউন্টিতে গ্রামের সামনে ও পেছনে শুধুমাত্র বড় বড় প্রাকৃতিক কর্পূরের বন ও সবুজ গাছই নেই বরং একটি জাতীয় দর্শনীয় স্থান, একটি জাতীয় প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষা এলাকা। একটি জাতীয় ভূতাত্ত্বিক উদ্যানও রয়েছে। রয়েছে হাজার বছরের পুরোনো কনফুসিয়ান মন্দির।
এই কাউন্টিটিকে সুন্দর দৃশ্যবলী, সুন্দর জায়গা, দীর্ঘ ইতিহাস ও অসামান্য মানুষের বসবাস হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। এটি ধীরে ধীরে পর্যটক ও ফটোগ্রাফিদের জন্য একটি জনপ্রিয় স্পট হয়ে ওঠছে। এখন আনফু কাউন্টিতে সর্বত্র কর্পূর গাছের সুগন্ধ বিরাজমান। প্রতি বছর চারটি ঋতুতে সবুজে পূর্ণ থাকে আনফু কাউন্টি ও দৃশ্যবলীর সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পায়।
কর্পূর গাছের শুধু শোভাময় মূল্যই নয়, পরিবেশকেও সুন্দর করে। তাছাড়া অত্যন্ত উচ্চ ঔষধি প্রভাব ও অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। কর্পূর গাছ ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চীনা ঔষধের খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শাখা, পাতা, বীজ, বাকল, কাঠ ও মূল ব্যবহার রয়েছে। কর্পূর গাছ এক ধরনের চারিত্রিক উদ্ভিদ যা মানুষের সারা শরীরের জন্য উপকারী। এটি চমৎকার কার্যকারিতাসহ এক ধরনের চীনা ভেষজ ওষুধ।
চিয়াংশি প্রদেশে প্রাচীন গাছগুলোকে ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনটি দিক থেকে শক্তিশালী করার সুযোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রথমত, প্রদেশের সমস্ত প্রাচীন ও বিখ্যাত গাছগুলোকে সুরক্ষার জন্য পুনরায় তালিকাভুক্ত করা।
দ্বিতীয়ত, ‘একটি গাছ, একটি নীতি’ অনুসারে কার্যকরভাবে বৃক্ষের বৃদ্ধি পুনরুদ্ধার করার জন্য বিপণ্ন, দুর্বল প্রাচীন ও বিখ্যাত গাছ উদ্ধার করা এবং পুনরুজ্জীবিত করার ব্যবস্থা।
তৃতীয়ত, প্রাচীন ও বিখ্যাত গাছের উন্নত ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা জন্য কাউন্টিগুলো নির্বাচন করা। গাছগুলোর ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষার পাইলট প্রকল্পগুলো পরিচালনা করা। সক্রিয়ভাবে প্রাচীন এবং বিখ্যাত গাছ রক্ষণাবেক্ষণ উদ্যেগ গ্রহণের প্রচার করা।
চিয়াংশি প্রদেশে ‘বৃক্ষরোপণ বৃদ্ধি করা ও কাটা নিষিদ্ধ করা বাঞ্ছনীয়’ হলো গ্রামের পূর্বপুরুষদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীর নিয়ম। এই প্রাচীন ও বিখ্যাত গাছগুলো শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদই নয় বরং ইতিহাস। পূর্বসূরিদের দ্বারা রেখে যাওয়া মূল্যবান ঐতিহ্য, সম্পদ।