সনু নিগাম কত গানে যে সুর দিয়েছেন তার হিসাব নেই। গুনতে গেলে হাজারের উপর। সঙ্গীতশিল্পী যশু দাস গেয়েছেন রেকর্ড সংখ্যক ৭৫ হাজার গান। অন্যদিকে কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ বা কেকের কথা যদি বলি তার গানের সংখ্যা কত? উত্তর নির্দিষ্ট না হলেও তার বন্ধুমহল ও সহশিল্পীদের মতে এই সংখ্যা পাঁচশোরও কম।
কিন্তু কেকের গানের সংখ্যা এত কম কেন? বেছে গান করার পেছনে কারণগুলো কী?
চাকচিক্য থেকে দূরে থাকা
চাকচিক্য বরাবরই অপছন্দ ছিল কেকের। তিনি কোনো পার্টিতে যেতে পছন্দ করতেন না। যে গানে তিনি আনন্দ পান সেই গান গাইতেন। অবসরে আবার একলা থাকতেন। এমন নয় যে তার বন্ধু-বান্ধব ছিল না। গায়ক শান ও সনু নিগামকে তার সমসাময়িকই বলা চলে। তবে তিনি তাদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার্টি করতেন না।
“কনসার্টের ক্ষেত্রে কেকে ব্যতিক্রম, এমন নয় যে কোনো মহারথী তাকে আমন্ত্রণ করলো আর তিনি মুখ উঠিয়ে পারফর্ম করতে চলে যাবেন,” হিন্দুস্তান টাইমসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন সঙ্গীত পরিচালক শঙ্কর মহাদেবন।
শঙ্কর আরো বলেন, “ও খুব বেছে বেছে কনসার্ট করতো। তার পছন্দের সাথে মিল রেখে কনসার্টে নাম লেখাতো।”
রেকর্ডিং অভিজ্ঞতা
শঙ্কর মহাদেবনের সাথে কেকের পরিচয় বেশ আগ থেকেই। ২০০১ সালে মুক্তি পাওয়া দিল চাহ তা হের গান রেকর্ডিংয়ের সময় হয় তাদের দেখা। আমির খান, অক্ষয় কুমার ও সাইফ আলী খান অভিনীত সেই বিখ্যাত গান ‘কোই কাহে কেহতা রাহে’ কেকের গাওয়া।
ওই সময়ের অভিজ্ঞতা এখনো মনে ধারণ করেন শঙ্কর। তিনি হিন্দুস্তান টাইমসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এর খোলাসা করেছিলেন।
তিনি কেকের মাঝে ভিন্ন কিছু দেখেছিলেন। যেমন, অন্যান্য তারকাদের মতো দেরি করে আসতেন না কেকে।
“রেকর্ডিংয়ের ১৫-২০ মিনিট আগে এসে একটি সিগারেট ধরাবে তারপর কুশল বিনিময় করে বলবে, লেটস ডু ইট!” কেকের স্মৃতিচারণ করেন শঙ্কর।
শঙ্কর মনে করেন কেকে চাইলেই বেশি গান করতে পারতেন, কিন্তু তিনি খুব সময় সচেতন ব্যক্তি ছিলেন যার কারণে বেছে বেছে গান করতেন।
পরিবারকে সময় দেয়া
কেকে একজন ‘ফ্যামিলি ম্যান’ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তার বেছে গান গাওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ পরিবার। সঙ্গীতশিল্পী শান বলেন, “আমরা গানের প্রস্তাব পেলে সহজে মানা করতাম না, ব্যস্ততা আমাদের পছন্দ। কেকে এর ব্যতিক্রম।”
একই ধরনের কথা বলেন শঙ্কর। তিনি বলেন, “কেকে প্রায়ই তার পরিবারকে নিয়ে ঘুরতে চলে যেতেন।”
বন্ধুদের আড্ডা কিংবা খোঁজ-খবর নেয়ার মধ্যেও পরিবার নিয়ে আলাপ করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল কেকের জন্যে।
“গায়করা মূলত কাজ নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন। তবে কেকে ‘আপনার মা কেমন আছেন’, ‘ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার কী অবস্থা’ এসব ব্যাপারে বেশি খোঁজ নিতেন”, বলেন শঙ্কর।
পুরস্কারে আগ্রহের কমতি
পুরস্কারের প্রতি ঝোঁক থাকা মোটেও খারাপ নয়। তবে এরজন্য গানও প্রচুর গাইতে হয়। কেকের মাঝে এরকম কোনো তাড়না ছিল না।
হিন্দুস্তান টাইমসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কেকে বলেছিলেন, “পুরস্কার না পেলেও আমি খুশি।”
নিজের সুবিধা ও পছন্দমতো কাজ বেছে নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন কেকে। বন্ধুত্ব ও সম্পর্ককে প্রাধান্য দিতেন।
“গায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে নিয়মিত কাজ না পাওয়া দুঃখজনক, কিন্তু আপনার চাওয়া – পাওয়া যদি হয় ছিমছাম জীবন তাহলে অল্প কাজই যথেষ্ট। তাই আমার পুরস্কার ও প্রচুর নাম ডাকের ইচ্ছে কোনো কালেই ছিল না। আগার কাম আয়েগা তো কার লেঙ্গে (যদি কাজ আসে তাহলে করে নিব)”
বাস্তবতায় থাকতে চাওয়া
“কেকে কখনো ভাবতো না কে তাকে নিয়ে কী ভাবছে, কী বলছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোমাধ্যম নিয়েও না,” জানান শঙ্কর মহাদেবন।
তার মতে কথা বলার মাধ্যম হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করা এখন নিত্য-নতুন কোনো বিষয় না। কিন্তু জনপ্রিয় এই গায়ক এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম। তাকে পুরানো ধাঁচের লোক বলা চলে।
শঙ্কর বলেন, “তার কোনো হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর ছিল না। তার সাথে কথা বলতে হলে সরাসরি তার নম্বরে ফোন দিতে হতো।”
এসব কারণেও অনেকটা গতানুগতিক জনপ্রিয় প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে তিনি গ্ল্যামার পাননি। তার এই আচরণের প্রতিফলন পেশাদারী জীবনে পরিলক্ষিত হয় বলে জানেন তার সহকণ্ঠশিল্পীরা।
কেকে এ প্রসঙ্গে বলেন, “আমি স্বাধীন ঘরানার মিউজিক করতে পছন্দ করি। আমি মনে করি রেডিওর জন্যে ভারতে স্বাধীন ঘরানার সঙ্গীত ফিরে আসছে।”
মূলত প্লেব্যাক গায়করা মেলোডি ঘরানার গানই গাইতে বেশি পছন্দ করেন। নব্বইয়ের দশকের ইন্ডি-পপ, রক, ব্লু’জ এর অন্তর্ভুক্ত নয়।
গ্যাংস্টার সিনেমার ‘কিউ আজকাল নিন্দ কাম’, ‘তুহি মেরি শাব হে’ আর পপ গান ‘পাল’ – এ ধরনের গানই কেকের পছন্দের। একথা তিনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন। বলিউড পাড়ায় এই ধরনের গান সচরাচর বাজে না। তাই কেকের গানের সংখ্যাটাও হাতে গোণার মতো।
‘আখো মে তেরি আজাবসি আজাবসি আদায়ে হে’ এই গানে প্রথম ভালো লাগার অনুভূতিতে সিক্ত হয়নি এমন কাউকে হয়ত পাওয়া যাবে না। আবার বন্ধুদের আড্ডায় কিংবা স্কুলের বেঞ্চে কোরাস হয়েছে ‘ইয়ারো দোস্তি বারি খুশ নাসিব হে’ গানটি। কেকে সুর দিয়েছেন এমন গানের সংখ্যা কম, তবে মন ছুঁয়েছে প্রায় তার সবকয়টি।