ইউক্রেইন যুদ্ধ: বিশ্বের খাদ্যভাণ্ডার হয়ে উঠতে পারবে ভারত? কি বলছে বিশ্লেষকরা

ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্যশস্যের সংকট দেখা দিয়েছে, লাফিয়ে বাড়ছে দাম। যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের জোগানে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা পূরণে ভারত প্রস্তত বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে মোদী একথা বলেন। তিনি জানান, নিজেদের ১৪০ কোটি মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য ভারতের কাছে ‘যথেষ্ট খাবার’ আছে।

“আর যদি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা অনুমতি দেয়, তবে ভারত আগামীকাল থেকেই বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের জোগান দিতে প্রস্তুত আছে।”

ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে খাদ্যশস্যের দাম গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ গম রপ্তানিকার দেশগুলোর অন্যতম ইউক্রেইন ও রাশিয়া।

এই দুই দেশ মিলে বিশ্ববাজারে এক-তৃতীয়াংশ গমের যোগান দেয়। এছাড়াও এই দুই দেশ বিশ্বজুড়ে ৫৫ শতাংশ সূর্যমূখী তেল এবং ১৭ শতাংশ ভুট্টা ও বার্লি রপ্তানি করে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ইউএনএফএও) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দুই দেশ মিলে এবছর এক কোটি ৪০ লাখ টন গম এবং এক কোটি ৬০ ‍লাখ টন ভুট্টা বিশ্ববাজারে রপ্তানি করবে বলে আশা করা হয়েছিল।

ইউএনএফএও-র ‍অর্থনীতিবীদ উপালি গালকেতি বলেন, ‘‘ওই জোগানে বিঘ্নসৃষ্টি হয়েছে এবং রাশিয়ার উপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার অর্থ সমীকরণ থেকে এইসব রপ্তানিও বাদ দিতে হবে। এক্ষেত্রে ভারত তাদের রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারে, বিশেষ করে তাদের হাতে যখন পর্যাপ্ত গম মজুদ আছে।”

ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ গম ও চাল রপ্তানিকারক দেশ। বিশ্বজুড়ে মানুষের প্রধান দুটি খাদ্য গম এবং চাল। বিবিসি জানায়, এপ্রিলের শুরুতেই ভারত সরকার সাত কোটি ৪০ লাখ টন করে গম এবং চাল মজুদ করেছে।

এছাড়াও কৌশলগত ‘রিজার্ভ এন্ড পাবলিক ডিসট্রিবিউশন সিস্টেম’ (পিডিএস) এর জন্য তারা আরো দুই কোটি ১০ লাখ টন করে বাড়তি গম এবং চাল মজুদ করেছে।

বিশ্বে যে কয়টি দেশ সবচেয়ে কম দামে গম এবং চাল সরবরাহ করে ভারত তার অন্যতম। দেশটি প্রায় ১৫০টি দেশে চাল এবং ৬৮টি দেশে গম রপ্তানি করে।

২০২০-২১ অর্থবছরে ভারত ৭০ লাখ টন গম রপ্তানি করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়তে শুরু করায় ব্যবসায়ীরা ভারতের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ করেছে এবং এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশটি ৩০ লাখ টন গম রপ্তানির অর্ডার পেয়ে গেছে।

‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনোমিক রিলেশন্স’ এ কৃষি বিষয়ক অধ্যাপক অশোক গুলাটি বলেন, এই অর্থবছরে ভারত দুই কোটি ২০ লাখ টন চাল এবং এক কোটি ৬০ লাখ টন গম রপ্তানি করতে সক্ষম।”

“যদি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) সরকারি মজুদ থেকে রপ্তানির অনুমতি দেয়, তবে ওই সংখ্যা আরও বাড়বে। সেটা হলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে এবং বিশ্বজুড়ে যেসব দেশ এসব পণ্য আমদানি করে তাদের উপরও চাপ কমবে।”

তবে কেউ কেউ বলছেন, অতি উৎসাহী হয়ে পুরো বিশ্বকে খাওয়ানোর দায়িত্ব ভারতের নিজের কাঁধে নেওয়া ঠিক হবে না।

এমনই একজন দিল্লি ভিত্তিক সংগঠন ‘দ্য সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ’ এর সিনিয়র ফেলো হারিশ দামোদারান। তিনি বলেন, ‘‘এই মুহূর্তে আমাদের হাতে যথেষ্ট মজুদ আছে। কিন্তু এখানও উদ্বেগের কিছু বিষয় রয়ে গেছে এবং বিশ্বকে খাওয়ানোর বিষয়ে আমাদের অতি উৎসাহী হওয়া একদমই উচিত হবে না।”

কারণ, সরকার রপ্তানি বাড়ালে দেশের ভেতর গরিব মানুষ খাদ্য সংকটে পড়তে পারে। তাছাড়া, সারের সংকটও রয়েছে। সেক্ষেত্রে যে পরিমাণ ফসল উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে, উৎপাদন তার থেকে কম হতে পারে।

ভারতে এখন গমের মৌসুম চলছে। এখনও ক্ষেতের ফসল কৃষকের ঘরে ওঠেনি। কর্মকর্তারা আশা করছেন, এবার রেকর্ড ১১ কোটি ১০ লাখ টন গম উৎপাদন হবে। যদি তাই হয় তবে ভারতে টানা ষষ্ঠ মৌসুমে গমের বাম্পার ফলন হবে।

কিন্তু এই আশার বানীতে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না হারিশ দামোদারান। তার বিশ্বাস, যা আশা করা হচ্ছে ফসল তার থেকে অনেক কম হবে। কারণ, এবার ভারতে সারের সংকট হয়েছে। সেইসঙ্গে বিরূপ আবহাওয়া ভয় ধরাচ্ছে। এবার অতিবৃষ্টির সঙ্গে গ্রীষ্মের আগেই মারাত্মক তাপদাহ শুরু হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘‘আমরা ফসল উৎপাদনের বিষয়টি অতিমূল্যায়ন করছি। আরও ১০ দিন পর প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে।”

ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে ভারতের সারের মজুদ কমে গেছে। আর সারের সংকট দেখা দিলে স্বাভাবিক ভাবেই আগামী মৌসুমে ফসল উৎপাদনে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। এক্ষেত্রে দামোদারান একটি উপায় বাতলে দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, ভারত সরকার মিশর বা আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে সারের বদলে গম চুক্তিতে যেতে পারে।

সমস্যা আরও আছে। যেমন: যদি যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে ভারত পণ্য পৌঁছানো নিয়েও সমস্যায় পড়বে। রপ্তানি বাড়লে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিবহন, গুদাম এবং জাহাজের চাহিদা বাড়বে। এত বড় চালান পাঠানোর সক্ষমতাও থাকতে হবে। পরিবহন খরচের কথাও মাথায় রাখতে হবে।

সর্বশেষে আছে দেশের চাহিদা পূরণ। এত খাদ্যপণ্য মজুদ থাকার পরও ভারতে গত মার্চে খাবারের দাম ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেড়েছে; যা গত ১৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির ধাক্কা ভারতের অভ্যন্তরেও লাগতে পারে এবং মূল্যস্ফ্রীতিতে বড় ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy