আমেরিকা, ব্রিটেন সহ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিভিন্ন দেশ, ৪ উপায়ে দেশ সামলাচ্ছে রাশিয়া

ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হলে রাশিয়ার নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে—এ কথা বারবার জানানোর পরও ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হওয়ার নানা প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। আর নিজেদের নিরাপদ রাখতে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া।

হামলার আজ দুই মাস হতে চলল। হতাহত, প্রাণহানি, অস্ত্রের সরবরাহ, নিষেধাজ্ঞা, পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা চলছে। এ যুদ্ধের জন্য ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়ার ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পশ্চিমারা। রাশিয়াকে বাগে আনতে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলারের অস্ত্রও উইক্রেনে পাঠিয়েছে পশ্চিমারা। পশ্চিমা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো রাশিয়া থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া দেশটির জন্য ধাক্কা হিসেবেই মনে করা হয়েছিল। তবে খুব একটা সুবিধা যে এতে হয়েছে, তা বলা মুশকিল। পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার মধ্যও যে যে উপায়ে তা মোকাবিলা করে কীভাবে ভালো থাকার প্রমাণ রাশিয়া দিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন।

এরই মধ্য শীর্ষ অর্থনৈতিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, রাশিয়ার ওপর আরোপ করা পশ্চিমাদের একের পর এক নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমারা আশা করেছিল, আর্থিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। বাজারে ভীতি ছড়িয়ে পড়বে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। দোকানগুলোতে পণ্যের আকাল দেখা দেবে। আকস্মিক অর্থনৈতিক আঘাতের কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। এতে উল্টো পশ্চিমের অর্থনীতির পতন হয়েছে। পুতিন বলেন, রাশিয়া নজিরবিহীন এ চাপ ঠেকিয়ে দিয়েছে। তাঁর যুক্তি, রুশ মুদ্রা রুবল শক্তিশালী হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৫৮ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য উদ্বৃত্তের রেকর্ড হয়েছে।

সম্প্রতি বিমান পরিবহনের কর্মকর্তাদের পুতিন বলেছেন, পশ্চিমাদের মিলিত শক্তি রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে দ্রুতই পিছু হটবে না। তাই দেশের ভেতরে থাকা সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়েই রাশিয়াকে দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যে চার উপায়ে রাশিয়া ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, সেগুলো জেনে নেওয়া যাক।

লাডাকে ঢেলে সাজানো
সোভিয়েত যুগের গাড়ির একটি ব্র্যান্ড লাডা। লাডার যন্ত্রাংশ অবশ্য আমদানি করতে হয়। দেশটির আভটভাজ কোম্পানি লাডার গাড়িগুলো তৈরি করে। তবে, সমস্যা এটি ফরাসি ব্র্যান্ড রেনো মালিকানাধীন। এ বছরের ২৪ মার্চ রেনোর রাশিয়ার বাজার ছেড়ে যাওয়ার খবরে আভটভাজ জানিয়েছে, তারা কয়েকটি মডেলের গাড়ি দ্রুত নতুন করে বাজারে আনতে যাচ্ছে। তবে, তা করা হবে আমদানি করা যন্ত্রাংশের ওপর বেশি নির্ভর না করেই।

রেনোর ঘোষণায় যে কী পরিমাণ ক্ষতি হবে, তা আভটভাজ অবশ্য জানায়নি। বরং তারা বলেছে, আসছে দিনগুলোতে রাশিয়ার তৈরি নতুন যন্ত্রাংসসহ গাড়িটি বাজারে আসবে। নতুন নকশা করার মানে হচ্ছে, গাড়িগুলোর কিছু ফিচার বাদ দিয়ে তৈরি করা হবে।

ইনস্টাগ্রামের ব্যবহারকারীরা আসছে কনটাকটিতে
যুদ্ধের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রাম রাশিয়ায় সেবা বন্ধ করে দেয়। তা সামলে উঠে আগেই কাজ শুরু করেছিল রাশিয়া নিজেদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কনটাকটি দিয়ে। কিছুদিন আগেও ব্যবহারের দিকে থেকে ইনস্টাগ্রাম ছিল রাশিয়ার সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। দ্বিতীয় স্থানে আছে কনটাকটি। এখন দিন দিন এর ব্যবহার বাড়ছে।

ইউক্রেনে হামলা ও এর পরে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের সেবা রাশিয়ায় বন্ধ হওয়ার পর কনটাকটির ডেভেলপাররা কনটেন্ট নির্মাতাদের তাঁদের প্ল্যাটফর্মে আনতে চাইছেন। এ জন্য তাঁরা কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। তা হলো, কোম্পানিটি আপাতত কোনো কনটেন্টের আয় থেকে এপ্রিল মাসে লভ্যাংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এমন কি কোনো কনটেন্ট নির্মাতা যদি মার্চের পর থেকে কনটাকটিতে যোগ দেন বা পুরোনো অ্যাকাউন্ট আবার চালু করেন, তাহলে তাঁদের ফ্রি প্রমোশনের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে।
কনটাকটির তথ্য–উপাত্ত অনুযায়ী, এ প্রক্রিয়া ভালোই কাজ করছে। গত মার্চে এ প্ল্যাটফর্মে রেকর্ড ১০ কোটি ব্যবহারকারী দেখা গেছে। অন্যদিকে রাশিয়াতে ব্যবহারকারী হারিয়েছে ইনস্টাগ্রাম। তবে ইনস্টাগ্রাম নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভিপিএন ব্যবহার করে এখনো ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করছেন রাশিয়ানরা।

রাশিয়ান ক্রেডিট কার্ড
২০১৪ সালে ক্রিমিয়ার ঘটনার পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার অনেক ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আর তখন থেকেই অর্থনৈতিকভাবে একঘরে হওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল রাশিয়া। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা সুফল পেয়েছে রাশিয়া। রাশিয়া নিজস্ব ন্যাশনাল পেমেন্ট কার্ড সিস্টেম ও ব্যাংক কার্ড সিস্টেম তৈরি করেছে, যা ‘মির’ নামে পরিচিত। ২০১৫ সালে যাত্রা শুরুর পর ‘মির’ সেবাটি দ্রুতই বড় হয়েছে। বাড়ছে আগ্রহ।

রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে ১৭ লাখ ৬ হাজার মির কার্ড ইস্যু করেছে। ২০২১ সালে কার্ডের সংখ্যা বেড়ে ১১ কোটি ৩০ লাখে দাঁড়িয়েছে। গত বছরে রাশিয়ার সব ধরনের কার্ডে আর্থিক লেনদেনের ২৫ শতাংশ হয়েছে মির কার্ডে।
ফিনল্যান্ডের ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের ভিজিটিং সিনিয়র ফেলো মারিয়া শাগিনা বলেন, ইউক্রেনে হামলার আগে নাগরিকদের কাছে ওই কার্ডটি বেশি আবেদনময় করে উপস্থাপন করেনি রাশিয়া। তার বদলে সরকার নির্ধারণ করেছিল সরকারি কর্মকর্তা, পেনশনভোগী ও অন্য যে কেউ কোনো সরকারি সেবা গ্রহণ করতে চাইলে তাঁদেরকে মির কার্ড ব্যবহার করতে হবে।

মার্চে ভিসা ও মাস্টারকার্ড রাশিয়ায় কার্যক্রম স্থগিত করার ঘোষণা দেয়। আদতে এ ঘোষণায় খুব একটা ধাক্কা খায়নি রাশিয়া। কারণ, রাশিয়ার কাছে নিজস্ব বিকল্প ইতিমধ্যে আছে। তবে মিরের কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এটি কেবল রাশিয়া ও অল্প কয়েকটি সাবেক সোভিয়েত দেশে কাজ করে।

আন্তর্জাতিক লেনদেনব্যবস্থা সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) থেকে বাদ দেওয়ার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই সুইফটের বিকল্প রাশিয়ার হাতে আছে, তা এসপিএফএস নামে পরিচিত। গত বছর মাত্র ৪০০ জন ব্যবহার করেছিলেন এই সেবা, সুইফটের ছিল ১১ হাজার ব্যবহারকারী। তবে দিনকে দিন এ সেবার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।

সরকারি চাকরিতে আগ্রহ বাড়ছে
ওয়াশিংটনের ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সের ডেপুটি চিফ ইকোনমিস্ট এলিনা রিবাকোভার মতে, ব্যাপক বেকারত্ব এখনো রাশিয়ায় দেখা যায়নি। তবে ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু হওয়ার পর অনেক রাশিয়ান রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছিলেন। তাঁদের অনেকে যে যুদ্ধ বন্ধের জন্য মিছিল করেছিলেন, অনেকে আবার নিজেদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ, চাকরি ইত্যাদির কথা চিন্তা করেই যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে নেমেছিলেন।

বর্তমানে মস্কো চেষ্টা করছে পশ্চিমা কোম্পানিগুলোতে কাজ করা চাকরি হারানো বিভিন্ন মানুষকে নতুন কাজের সুযোগ করে দেওয়ার। মস্কোর মেয়র সের্গেই সোবিয়ানিন মনে করছেন, কমপক্ষে দুই লাখ মানুষের চাকরি ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে তাঁরা চাকরি হারাননি।

এদিকে নতুন চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করতে ৪ কোটি ১০ লাখ ডলারের একটি বরাদ্দ রেখেছে মস্কো। তবে অনেকের ধারণা, পশ্চিমা কোম্পানিগুলোতে যেসব রাশিয়ান উচ্চ পদে আসীন ছিলেন, তাঁরা দেশ ছেড়ে বাইরে চলে যেতে পারেন।

এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে
চলতি বছর রাশিয়ার অর্থনীতি ১১ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিয়েছে রাশিয়া, এটি বলা যায়। দেশটির অর্থনীতি এখনো ধসে পড়েনি। এর প্রধান একটি কারণ হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খুব দ্রুত সুদহার ২০ শতাংশে তুলে দেওয়া ও পুঁজি নিয়ন্ত্রণ করা। তবে এর অর্থ মানে এই নয় যে রাশিয়ার সামনে আর কোনো দুরবস্থা তৈরি হবে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার অর্থনীতি ৮ দশমিক ৫ শতাংশ কমে যেতে পারে এ বছর। ইউরোপ যদি রাশিয়ান তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাহলে অর্থনীতির এ ধস আরও বেশি হবে।

অবশ্য রাশিয়ায় ভোগ্যপণ্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করেছেন পুতিন। সপ্তাহখানেক আগে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, বছরভিত্তিক হিসাবে এপ্রিল নাগাদ ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্য বেড়েছে। আয়ের ওপর মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব লাঘব করতে বেতন ও অন্যান্য ভাতাদি সামঞ্জস্য করতে সরকারকে নির্দেশনা দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। তবে পুতিনও একমত যে এভাবে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ রাশিয়ানরা। রাশিয়ার জন্য আরেকটি বড় ঝুঁকি হলো দেশটির আমদানি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা। এসব পণ্যের অনেকগুলো বর্তমানে নিষেধাজ্ঞার কবলে আছে।

Related Posts

© 2024 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy