কাজে মন না বসলেও যাঁরা জরুরী কাজটি সময়মত করে ফেলতে পারেন, তাঁরাই আসলে সব জায়গায় সেরা স্থান দখল করতে পারেন। কাজে মন না বসা তাঁদের কাছে একটা অজুহাত মাত্র। মন বসছে কি বসছে না – অথবা, ভালো লাগছে কি লাগছে না – এসব তাঁদের কাছে কোনও ব্যাপারই নয়। কাজ করা জরুরী, তাই কাজ করতে হবে। এবং তাঁরা সেটা করেও দেখান। কেউ কেউ এটা সব সময়েই পারেন, কেউবা চর্চার মাধ্যমে এই ক্ষমতা অর্জন করেন।
সত্যিকথা বলতে কাজে মন না বসলেও ভালোভাবে কাজ করতে পারা এতটা সহজ নয়। তাহলে পৃথিবীর সবাই বড় বড় সফল মানুষ হয়ে যেত। কিন্তু এটা অসম্ভবও নয়। বহু মানুষ এটা করে দেখিয়েছেন। আপনিও পারবেন। শুধু সঠিক উপায়ে চেষ্টা করে যেতে হবে। এই উপায়গুলো হয়তো একদিনেই আপনাকে সুপার প্রোডাক্টিভ বানিয়ে দেবে না। কিন্তু ধৈর্য ধরে চর্চা করে গেলে আপনি যে কোনও অবস্থাতেই প্রয়োজনীয় কাজটি সময়মত সুন্দর ভাবে করে ফেলতে পারবেন।
০১. লক্ষ্যকে ‘ডিজাইন’ করুন
আমরা সব সময়েই লক্ষ্য ঠিক করা এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করার কথা শুনি। কিন্তু শুধু একটি লক্ষ্য ঠিক করা এবং তার জন্য কাজ শুরু করাই কি যথেষ্ঠ? আসলে শুধু লক্ষ্য ঠিক করলেই হবে না। সেটাকে রীতিমত ডিজাইন করতে হবে। চোখ বন্ধ করলেই যেন পুরো রোডম্যাপ চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
বেশকিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব কর্মীকে কোম্পানীর পক্ষ থেকে টার্গেট ঠিক করে দেয়া হয়, তারা বেশি সফল ভাবে নিজেদের কাজ করতে পারে।
লক্ষ্য ডিজাইন করা মানে একটি লক্ষ্য ঠিক করে তার পূরণের জন্য প্রতিটি কাজ স্পষ্ট ভাবে ঠিক করা।
ধরুন, একজন লোক লক্ষ্য ঠিক করলেন ৩ মাসের ভেতরে তিনি ১০ কেজি ওজন কমাবেন। ওজন কমানোর জন্য তিনি প্রতিদিন নিয়মিত ব্যায়াম করবেন, এবং আগের চেয়ে কম খাবেন।
এই ধরনের অস্পষ্ট লক্ষ্য সাধারণত পূরণ হয় না। কারণ লক্ষ্যের অস্পষ্টতার কারণে তিনি আসলে কতটা কি করবেন – সেটাই ভালোমত বুঝতে পারবেন না। এই কারণে ওজন কমানোর জন্য নিয়মিত কাজ করে যাওয়ার মটিভেশনই তাঁর মধ্যে আসবে না। তিনি যেদিন ভালো লাগবে, সেদিন বেশি ব্যায়াম করবেন। আর যেদিন লাগবে না, সেদিন হয়তো করবেনই না।
এর বদলে তিনি যদি লক্ষ্য ঠিক করেন, তিনি প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ৭টা পর্যন্ত ১ ঘন্টা শরীরচর্চা করবেন। এর মধ্যে থাকবে ৩০ মিনিট দৌড়ানো, বাকি ৩০ মিনিট এর ১০ মিনিট পেটের চর্বি কমানোর ব্যায়াম, ১০ মিনিট বুকডন, এবং ১০ মিনিট জাম্পিং জ্যাক – তাহলে তাঁর লক্ষ্যটি অনেক বেশি নির্দিষ্ট হবে। এছাড়া দুপুর বেলায় ১ প্লেটের বেশি ভাত খাবেন না, রাতের বেলা ৩টি রুটি ও সব্জী খাবেন। – এর ফলে তাঁর লক্ষ্যটি অনেক বেশি নির্দিষ্ট হবে। তিনি খুব ভালোভাবে জানবেন, কখন তাঁকে কি করতে হবে। এভাবে প্রতিদিনই তাঁর ওজন কমানোর ব্যাপারে নতুন করে মোটিভেশন সৃষ্টি হবে। প্রতিদিন এই নির্দিষ্ট কাজগুলো না করলে তাঁর নিজেরই ভালো লাগবে না।
আপনার লক্ষ্য যেটাই হোক, সেটাকে যত ভালোভাবে পারেন বিস্তারিত ভাবে ডিজাইন করুন। ঠিক কখন, কোন কাজটি কিভাবে ও কতক্ষণ করবেন – তা খুব ভালোভাবে ঠিক করুন। প্রয়োজনে লিখে রাখুন। করনীয় কাজগুলো লিখে রাখলে সেই কাজ করার আগ্রহ ও তাকে গুরুত্ব দেয়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে যায়।
০২. কাজের ফলাফলের ওপর ফোকাস করুন
মুড না থাকলে কাজ করতে ইচ্ছা করবে না, এটা খুবই স্বাভাবিক। সব সময়ে মানুষের মুড এক রকম থাকে না। সব সময়ে কাজের মানও এক রকম হয় না। কিন্তু আগেই বলেছি কিছু মানুষ এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেন। মুড না থাকলেও নিজের সেরা পারফর্মেন্স দেয়ার জন্য অনুপ্রাণীত থাকতে পারেন। এটা করতে পারার আরেকটি দারুন পদ্ধতি হল, কাজের সময়ে কাজের ফলাফলের দিকে ফোকাস করা।
ভালো কিছু পাওয়ার জন্য অনেক সময়েই আমাদের কষ্টকর কাজ করতে হয়। এই কাজ গুলো করতে অনেক সময়েই ভালো লাগেনা। কারণ এগুলোর মধ্যে মজার কিছু নেই। ব্যাপারটা কিছু শেখার সময়েও ঘটে।
কোনওকিছুতে দক্ষ হওয়ার আগে সেই কাজ করতে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। যে কম্পিউটারে টাইপ করতে দক্ষ নয়, তার কাছে এটা খুবই বিরক্তিকর ও কষ্টকর কাজ। কিন্তু যে দক্ষ হয়ে গেছে, তার কাছে এটা বেশ মজার একটা কাজ। কিন্তু ব্যাপারটাকে মজার পর্যায়ে নিয়ে আসার আগে দক্ষ মানুষটিকেও বেশ কষ্টকর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। অনেক সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটে। – এই অবস্থায় অনেকেই কাজের মোটিভেশন হারিয়ে ফেলেন।
এসব ক্ষেত্রে হাই পারফর্মাররা কাজের ফলাফলের দিকে ফোকাস করেন। কাজটা শেষ হলে সাফল্য উপভোগ করতে কেমন লাগবে – এটা নিয়ে তাঁরা চিন্তা করেন।
বিখ্যাত সেলফ ডেভেলপমেন্ট ক্লাসিক থিংক এ্যান্ড গ্রো রিচ বইয়ে লেখক নেপোলিয়ন হিল বলেছেন, কোনও কাজে সফল হতে চাইলে, সেই কাজে সফল হওয়ার পর কি হবে – তা নিয়মিত ভাবা উচিৎ। দিনের একটা সময়ে নিরিবিলি বসে চিন্তা করা উচিৎ। সফল হওয়ার পর কেমন অনুভূতি হবে – তা অনুভব করার চেষ্টা করা উচিৎ।
লক্ষ্য পূরণের কাজ করার ক্ষেত্রে অনেকেই বড় একটা ভুল করে। তারা কল্পনা করে লক্ষ্য খুব সহজেই পূরণ হবে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমনটা হয় না।
যদি কেউ ধরে নেয় যে, তার লক্ষ্য খুব সহজে বিনা কষ্টে পূরণ হয়ে যাবে – তাহলে কাজ শুরু করার পর বাধা ও কষ্ট দেখলে কাজ করার ইচ্ছা নষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক।
হাই পারফর্মাররা প্রথমেই মেনে নেন যে, বড় কিছু অর্জন করতে হলে কষ্ট হবেই। এমন অনেক কিছু করতে হবে, যা উপভোগ্য নয়। কিন্তু তারপরও তাঁরা সেই কাজগুলো খুব সুন্দর ভাবে করতে পারেন, কারণ তাঁরা এইসব কাজ করার সময়ে এবং কাজ করার আগে, কাজে সফল হলে কি হবে তা ভেবে নেন। এটা তাঁদের কষ্টকর কাজ সুন্দরভাবে করার জন্য অনুপ্রাণিত করে।
আপনি যদি একটি চাকরি করেন, তবে তার সব কাজ হয়তো আপনার ভালো লাগবে না। কাজের কিছু অংশ হয়তো উপভোগ করবেন, কিছু অংশ করবেন না। কিন্তু ক্যারিয়ারে সফল হতে চাইলে তবে সবগুলো কাজই ভালোভাবে করতে হবে।
যে কাজগুলো করতে ভালো লাগে না অথবা মুড আসে না, সেগুলোর ক্ষেত্রে চিন্তা করুন সেগুলো করলে আপনার ক্যারিয়ারের কি উপকার হবে। প্রমোশন, বেতন বৃদ্ধি – ইত্যাদি বিষয়ে এই কাজগুলো কিভাবে আপনাকে সাহায্য করবে – তা চিন্তা করুন। দেখবেন অনেক সহজে কাজগুলো করতে পারছেন।
ব্যবসার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনই। ধরুন, আপনি একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার, এবং আপনার একটি গ্রাফিক্স ডিজাইন ফার্ম আছে। আপনি এই কাজটি খুবই উপভোগ করেন। যেহেতু এটা আপনার নিজের ব্যবসা, তাই গ্রাফিক্স ডিজাইনের পাশাপাশি আপনাকে এর আয় ব্যয়ের হিসাব রাখা ও বাজেটের কাজ করতে হয়। এই কাজগুলো আপনার করতে ভালো লাগে না। কিন্তু আপনাকে চিন্তা করতে হবে, ব্যবসাকে লাভজনক ভাবে এগিয়ে নিতে হলে এই কাজগুলো করতে হবে। এগুলো ঠিকমত করলে আপনার ব্যবসা আর্থিক ভাবে অনেক এগিয়ে যাবে – যা একটা সময়ে আপনাকে দারুন সাফল্য এনে দেবে।
কাজ করার পুরস্কারের পাশাপাশি কাজ না করার বিপদের কথাও মনে করুন। এটাও আপনাকে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করবে।
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়ার গবেষকরা দুই দল লোককে ৬ মাসের জন্য প্রতিদিন ৭০০০ পা হাঁটতে বলেন। একদলকে বলা হয়, যদি তারা এটা করতে পারে, তবে তাদের আর্থিক পুরস্কার দেয়া হবে। আরেক দলকে বলা হয় করতে না পারে তাহলে প্রতিদিন তাদের কাছ থেকে টাকা কাটা হবে।
৬ মাস পর দেখা গেল, দ্বিতীয় দলের লোকরা প্রথম দলের লোকদের চেয়ে ৫০% বেশি সাফল্যের সাথে তাদের এ্যাসাইনমেন্ট করতে পেরেছে।
কাজ করলে কি লাভ হবে – এই চিন্তা করার পাশাপাশি, কাজ না করলে কি ক্ষতি হবে – এই চিন্তাও মানুষকে কাজ করার জন্য যথেষ্ঠ উৎসাহ দেয়।
সামনে একটি জরুরী কাজ পড়ে আছে, কিন্তু কাজ করতে ইচ্ছা করছে না – তখন চিন্তা করুন, কাজটি সময়মত না করলে হয়তো প্রমোশন বা বোনাস মিস করবেন। অথবা একটা ডিল হাতছাড়া হয়ে যাবে। অথবা যথেষ্ঠ বিশ্রামের সময় পাবেন না। – এমন যে কোনওকিছু হতে পারে।
এই ধরনের চিন্তা আপনাকে মুড না থাকলেও কাজ করার তাগিদ দেবে। এবং আপনার সার্বিক পারফর্মেন্স ভালো হবে।
০৩. অন্যদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিন
মানুষ সামাজিক জীব। আমরা সব সময়েই আমাদের আশপাশের মানুষের দিকে খেয়াল করি। এবং তাদের কাজ আমাদের প্রভাবিত করে। একজন হাই পারফর্মারের সাথে কথা বলা, তার কাছাকাছি বসে কাজ করা আপনাকেও ভালো পারফর্ম করতে উৎসাহ দিতে পারে।
তবে এখানে একটা সমস্যা হল, কিছু মানুষ অন্যকে ভালো কাজ করতে দেখে নিজেকে আরও দুর্বল ভাবে এবং কাজের উৎসাহ আরও হারিয়ে ফেলে। এটা খুব স্বাভাবিক একটা প্রতিক্রিয়া। যে কারওই এমন হতে পারে। আপনার যদি কারও কাজ দেখে এমন মনে হয়, তবে খুব সহজেই আপনি পজিটিভ চিন্তা করার মাধ্যমে এটা কাটিয়ে উঠতে পারেন। আরেকজনের ভালো পারফর্মেন্স দেখে নিজেকে ছোট ভাবার বদলে ভাবুন যে, আপনিও চেষ্টা করলে তার মত কাজ করতে পারবেন। মুড থাকুক বা না থাকুক – আপনিও তার মত হাই পারফর্মার হতে পারবেন।
কিন্তু কর্মক্ষেত্রে একটা সমস্যা হল, আমরা সব সময়ে নিজের ইচ্ছামত মানুষের আশপাশে কাজ করতে পারিনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আসন নির্দিষ্ট করা থাকে। এবং দুর্ভাগ্যক্রমে যদি লো পারফর্মারদের আশপাশে ডেস্ক বা কাজের জায়গা পড়ে যায় – তাহলে সেই প্রভাব আপনার ওপরও পড়তে পারে।
এক্ষেত্রে উৎসাহের জন্য অন্য উপায় খুঁজে বের করুন। প্রতিদিন সকালে কাজে যাওয়ার আগে সেলফ ডেভেলপমেন্ট বই পড়তে পারেন বা বকতৃতা শুনতে পারেন। এই পদ্ধতিটি ইউরোপ আমেরিকায় বিল্পব ঘটিয়ে দিয়েছে। দিনের শুরুতে মোটিভেশনাল উক্তি পড়া বা শোনা, বই পড়া বা বকতৃতা শোনা একজন মানুষের মনের জোর বাড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি কাজের উৎসাহও অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। কাজ শুরু করার অনেক আগেই আপনি কাজের মুডে চলে যাবেন। যে কোনও কাজই করতে ভালো লাগবে।
হ্যাল ইলরড তাঁর বিখ্যাত সেলফ ডেভেলপমেন্ট বই মিরাকেল মর্নিং এ দেখিয়েছেন, কিভাবে দিনের শুরুতে কিছু ইতিবাচক কাজ মানুষের জীবনকেই বদলে দিতে পারে।
আপনি চাইলে কাজের ফাঁকেও মোবাইলে বা কম্পিউটারে এসব অনুপ্রেরণামূলক বিষয় চর্চা করতে পারেন। এতে করে আপনার কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। সেইসাথে, আশপাশের মানুষ ও আপনার মুড আপনাকে সঠিক কাজটি করা থেকে নিরুৎসাহিত করতে পারবে না।
পরিশিষ্ট:
পজিটিভ সাইকোলজি বলে, একজন মানুষ তখনই তার কাজটি সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারে, যখন সে নিজেকে কাজে পুরোপুরি মনোযোগী করতে পারে। সত্যি কথা বলতে এটা খুব সহজে আসে না। দিনে হাজারটা বিষয় আমাদের মুডকে প্রভাবিত করে। কিন্তু ভালো কিছু করতে গেলে আমাদের এগুলোকে মোকাবেলা করে কাজে মনোযোগ দেয়া শিখতে হবে। মুডকে পরাজিত করে সাফল্যের জন্য কাজ করার উদ্দীপনা নিজের ভেতরে সৃষ্টি করতে হবে। – এভাবেই আসলে একজন মানুষ তার কাজের ক্ষেত্রে বড় সাফল্য পায়।