এশিয়া মহাদেশের মধ্যেই সর্ববৃহত্ত যৌনপল্লী কলকাতার সোনাগাছি। এই যৌনপল্লীতে আছেন এক লাখেরও বেশি যৌনকর্মী। আজও এসব যৌনকর্মীর নিত্যদিনের রুটিরুজির গল্প রচিত হয় এই সোনাগাছিতে। আজ (২ জুন) আন্তর্জাতিক যৌনকর্মী দিবস। চলুন, এ দিনে জেনে নেই কলকাতার সোনাগাছি যৌনপল্লীর আদ্যোপান্ত।
সোনাগাছি উত্তর কলকাতার মার্বেল প্যালেসের উত্তরে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, শোভাবাজার ও বিডন স্ট্রিটের সংযোগস্থলের নিকটে অবস্থিত। জনশ্রুতি রয়েছে, জনৈক সোনা গাজির দরগা ছিল এই অঞ্চলে। তার থেকেই নাম সোনাগাছি। বহু নারী এই পল্লীতে যৌন পেশায় জড়িত।
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি বাবু সম্প্রদায় এই অঞ্চলে নিজ নিজ উপপত্নীদের প্রতিপালন করতেন। এই অঞ্চলের বেশ কিছু বাড়ি নির্মিত হয়েছিল ব্রিটিশ যুগে। কথিত আছে প্যারিসের বিখ্যাত যৌনকর্মীরাও কলকাতার এই সোনালি অঞ্চল (Golden district)-এর খ্যাতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।
১৮৫৩ সালে প্রকাশিত একটি সার্ভে রিপোর্ট থেকে জানা যায়, কলকাতা শহরে চার হাজার ৪৪৯টি ঠেক আছে, যেখানে বসবাস করেন প্রায় ১২ হাজার ৪১৯ জন যৌনকর্মী। যার মধ্যে অন্যতম সাড়া জাগানো যৌনপল্লী ছিল ‘সোনাগাছি’।
ইতহাস বলছে, ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তৃতির মধ্যেই আগমন ঘটে ইংরেজদের। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যের সূত্রে কলকাতায় আগমন হয় প্রচুর রাজকর্মচারীর। তারা বেশিরভাগই ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিচুতলার কর্মী এবং বেশিরভাগই অবিবাহিত। ফলে এই ব্রিটিশ রাজকর্মচারীদের আপ্যায়নের জন্যই প্রায় তেতাল্লিশটি বেশ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এসবের বেশিরভাগ কোঠাতেই ইংরেজ কর্মচারীরা তাদের আমোদ ফূর্তির জন্য বরাদ্দ রাখতেন এক বা একাধিক উপপত্নী। এই উপপত্নীরা বিবেচিত হতেন ইংরেজ কর্মচারীদের আনন্দের উপকরণ হিসেবে। ব্রিটিশ সরকারের আমলেই মূলত সোনাগাছি বৃহৎ রূপ পায়।
শুধুমাত্র ইংরেজ কর্মচারীরাই নন, তৎকালীন সময়ে অনেক বাঙালি বাবুরা মুক্তাঞ্চলও হয়ে ওঠে এইসব যৌনপল্লী। যার মধ্যে অন্যতম ছিল সোনাগাছি। এরপর স্বাধীন ভারতে ক্রমশ এই এলাকার ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে। যে কারণে একটা সময় পুরো অঞ্চলটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে রেডলাইট জেলা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
বর্তমান সোনাগাছি খুবই জীর্ণ একটি এলাকা। ভবনগুলোও পুরনো। সরু সরু গলি চলে গেছে এদিকে-ওদিকে। তার একপাশে হয়তো যৌনকর্মীদের বাড়িঘর আর অন্যপাশে আবাসিক ভবন।
এক পরিসংখ্যান বলা হয়েছে, এই এলাকায় প্রতিদিন দেহ বিক্রি করছে প্রায় হাজার হাজার যৌনকর্মী। এসব যৌনকর্মীর নিত্যদিনের রুটিরুজির গল্প রচিত হয় সোনাগাছিতে। এখানে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করে বহু মানুষ। আসে খদ্দের ও দালাল। বাইরে থেকেও আসে ফেরিওয়ালারা।
সোনাগাছিতে অধিকাংশ যৌনকর্মীই নিজের পরিচয় হিসেবে ভিন্ন নাম ব্যবহার করে পিতা-মাতার দেয়া নামের পরিবর্তে। কারণ তারা নিজেরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও তাদের পরিবারতো আর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। তাই তাদের কারণে সমাজ যেন পরিবারের কোনো ক্ষতি বা নেতিবাচক মনোভাব পোষণ না করতে পারে সেজন্যই তারা ভিন্ন নাম ব্যবহার করেন। আবার অনেকেই আছেন যারা শুধুমাত্র যৌনতৃপ্তির জন্যই এই পেশা বেছে নেন ভিন্ন নাম ব্যবহার করে।
দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি (ডিএমএসসি) ভারতের প্রথম জাতীয় যৌনকর্মী সম্মেলনের আয়োজন করে। ১৯৯৭ সালের ১৪ নভেম্বর কলকাতায় আয়োজিত এই সম্মেলনের শিরোনাম ছিল ‘সেক্স ওয়ার্ক ইজ রিয়েল ওয়ার্কঃ উই ডিম্যান্ড ওয়ার্কার্স রাইট’। সেই থেকেই যৌনকর্মীরা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছেন। তা সত্যেও মাঝেমধ্যেই এই যৌনপল্লী থেকে নারী পাচারের অভিযোগ ওঠে।
এই পেশায় যারা বয়স্ক হয়ে যায় তাদের অধিকাংশেরই আর সোনাগাছিতে জায়গা হয় না। যদিও এই পেশা পৃথিবীর আদিমতম পেশা। ভারতে যৌনপেশা অবৈধ হলেও সোনাগাছি নিয়ে কোনো টানাহেচড়া করে না সরকার। কলকাতার সরকার এই মানুষগুলোর জীবন এবং তাদের জীবিকাকে মেনে নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কোনো সরকারই সোনাগাছিকে উচ্ছেদ করতে চায়নি। হয়তোবা এটা কতকটা সংস্কৃতিগত কারণে, কতকটা রাজনৈতিক কারণে। কারণ পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘবছর কমিউনিস্ট শাসন থাকার পরেও যেহেতু সোনাগাছির মতো স্বীকৃত যৌনপল্লীর কিছু হয়নি, তাই এর শেকড় যে অনেক গভীরে পুতে রাখা আছে সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।