বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি মানুষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি এবং পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় উন্নত থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল সব দেশই মূল্যস্ফীতির চাপে নাকাল।
জাতিসংঘ বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে পণ্যের দাম বাড়ছে হু হু করে। যুদ্ধ পরিস্থিতি উন্নতি না হলে আগামীতে দেশে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেবে। মারাত্মক দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে হবে বিশ্বকে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মুখ্য অর্থনীতিবিদ গীতা গোপিনাথ বলেন, চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা প্রণীত খাদ্যমূল্য সূচক মার্চে সর্বকালের সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। এ সময় ওই সূচক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৯ দশমিক ৩ পয়েন্টে। এপ্রিল মাসেও সূচকের উর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত ছিল। মূলত দানাদার শস্য ও ভেজিটেবল অয়েল বা উদ্ভিজ্জ তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এতটা বেড়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে দরিদ্র দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন থেকে রপ্তানি স্বাভাবিক না হলে বিশ্ব দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে পারে।
রাশিয়ার হামলার কারণে ইউক্রেনের বন্দরগুলো দিয়ে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ এসব বন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণ সূর্যমুখী তেল, গম ও ভুট্টা রপ্তানি হতো। এগুলো বন্ধ হয়ে পড়ায় এখন বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যাপক কমেছে এবং এর ফলে বিশ্বব্যাপী এসব পণ্যের দাম ব্যাপক বেড়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে গত বছরের তুলনায় এ বছর খাদ্যপণ্যের দাম ইতোমধ্যেই সারা বিশ্বে অন্তত ৩০ শতাংশ বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মাসেই মূল্যস্ফীতির নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৩২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর মার্চ ও এপ্রিলে মূল্যস্ফীতির হার ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূলত জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা মূল্যস্ফীতির হার মার্চে ৮ দশমিক ৫ শতাংশে উঠেছে, যা ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরের পর সর্বোচ্চ। এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি কমেছে সামান্য।
মূল্যবৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নাগরিক খাদ্য, জ্বালানিসহ নানা নিত্যপণ্য ক্রয়ে হিমশিম খাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের মূল্যস্ফীতির হার গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশ, যা ১৯৮২ সালের পর সর্বোচ্চ। যুক্তরাজ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভূমিকা রাখছে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি। কানাডায় এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ, যা দেশটির ৩০ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
ইউরোজোনের ১৯ দেশে গত মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে রেকর্ড ৮ দশমিক ১ শতাংশ। ১৯৯৭ সালে ইউরো চালু হওয়ার পর এটাই সর্বোচ্চ। জাপানে যেখানে ১৯৮০-র দশকের মন্দার পর ধারাবাহিকভাবে জিনিসপত্রের দাম কমে আসছিল বলে মূল্যস্ফীতি ছিল ঋণাত্মক, সেই দেশটিতেও গত এপ্রিলে ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। ভারতেও টানা কয়েক মাস মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে চলেছে।
এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয় ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ, যা গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। শ্রীলংকায় এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে রেকর্ড ২৯ দশমিক ৮০ শতাংশ হয়েছে। পাকিস্তানে এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশে। তুরস্কে এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে প্রায় ৫২ দশমিক ৩৭ শতাংশ হয়েছে, যা কয়েক দশকে সর্বোচ্চ। গত মাসে ইন্দোনেশিয়ার মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ, যা দুই বছরে সর্বোচ্চ।
ইরানে নিত্যপণ্যের দাম কয়েক মাসের ব্যবধানে ৩০০ শতাংশ বেড়েছে। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে দেশটিতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, মার্চে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ২২, যা গত ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২০ সালের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি উঠেছিল ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশে।
সর্বশেষ গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। বিশ্বজুড়ে এভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে কয়েক দশকে সর্বোচ্চ হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ওপর দ্রুত সুদের হার বাড়ানোর চার বাড়ছে। ফোর্বস ম্যাগাজিন বলছে, ১৯৮০-র দশকের শুরুর দিকের পর এই প্রথম এত দ্রুতগতিতে বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম। আর মূল্যস্ফীতির এই ঊর্ধ্বগতি দ্রুত কমছে না।