‘তুমি কুৎসিত, আমার যোগ্য নও’! স্বামীর লাঞ্ছনা সহ্য করে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সোনার পদক জয়! উত্তরবঙ্গের গীতাঞ্জলির লড়াইয়ের কাহিনি

“তুমি কুৎসিত, আমার যোগ্য নও”— একসময় স্বামীর কাছ থেকে প্রতিদিন এই অপমান সহ্য করতে হয়েছিল জলপাইগুড়ির ধুপগুড়ির বাসিন্দা গীতাঞ্জলি সাহাকে। গ্র্যাজুয়েশন শেষ না হতেই পারিবারিক চাপে বিয়ে, তারপর শ্বশুরবাড়িতে চরম মানসিক অত্যাচার ও লাঞ্ছনা। কিন্তু অতীতের সেই সব কান্না, যন্ত্রণা আর অপমান মুছে ফেলে আজ তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করলেন। নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান পাওয়ারলিফটিং চ্যাম্পিয়নশিপে একটি সোনা এবং একটি সিলভার মেডেল জিতেছেন উত্তরবঙ্গের এই লড়াকু নারী।
‘দ্য কব আনটোল্ড’স’-এর ফেসবুক হ্যান্ডেল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে গীতাঞ্জলির বিয়ে হয়েছিল গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল পরীক্ষার পরই। কিন্তু সাংসারিক জীবন তাঁর জন্য সুখকর হয়নি।
গীতাঞ্জলির অভিযোগ, শ্বশুরবাড়িতে স্বামী এবং তাঁর পরিবার তাঁকে ক্রমাগত অপমান, মানসিক অত্যাচার করতেন। তাঁর স্বামী প্রায়শই বলতেন, “আমি কুৎসিত… আমাকে নাকি পাতেও দেওয়া যায় না!”
এছাড়াও তাঁর স্বামী বাবার থেকে ২০ লক্ষ টাকা এবং বাড়ি লিখে না আনলে ভালোবাসা পাওয়া যাবে না বলে চাপ সৃষ্টি করতেন। মানসিক অত্যাচার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে বাধ্য হয়ে স্বামীর সাথে তাঁর বিচ্ছেদ (ডিভোর্স) হয়। যদিও আইনি লড়াই এখনও আদালতে চলছে।
বিচ্ছেদের পর শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলেন গীতাঞ্জলি। তবে, ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় মায়ের সহযোগিতায়। মায়ের উদ্যোগে জিমে ভর্তি হন গীতাঞ্জলি। ভুল ব্যায়াম করার কারণে বাঁ হাতে গুরুতর চোট পেয়ে তাঁর হাতের দুই হাড়ের মাঝে বড় গ্যাপ তৈরি হয়। স্থানীয় ডাক্তাররা হাত তুলে নেওয়ার পর শিলিগুড়ির ডাক্তারদের কাছে নতুন করে চিকিৎসার সুযোগ পান তিনি।
আর সেখানেই তাঁর পরিচয় হয় গুরু সোনু শর্মার সাথে। তাঁর হাতে ধরেই একজন পাওয়ার লিফটার হিসেবে নিজের দ্বিতীয় জীবন শুরু করেন গীতাঞ্জলি।
পাওয়ার লিফটার হিসেবে প্রথমে ডিস্ট্রিক্ট, তারপর বেঙ্গল চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জেতার পর ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপেও সোনা, সিলভার এবং ব্রোঞ্জ জেতেন গীতাঞ্জলি। জন্ম নেয় আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছানোর খিদে। কিন্তু বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল। কোনো দিক থেকে আর্থিক সাহায্য না পাওয়ায়, শেষ পর্যন্ত তাঁর মা মেয়ের জন্য নিজের সোনার গয়না বিক্রি করে দেন।
এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সম্প্রতি নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান পাওয়ারলিফটিং চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৫-এ অংশ নিয়েই তিনি সোনার পদক ও সিলভার মেডেল জিতে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেন। নিজের এই আন্তর্জাতিক সাফল্য দিয়ে তিনি অতীতের সমস্ত যন্ত্রণা, অপমান এবং শারীরিক ব্যথাকে মুছে দিলেন।