বিশেষ: মানুষের ত্বকের DNA থেকে ভ্রূণ তৈরি করলেন বিজ্ঞানীরা, জেনেনিন বিস্তারিত

মানব প্রজনন (Human Reproduction) বিজ্ঞানে এক বিশাল মাইলফলক স্থাপন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানী। তারা প্রথমবারের মতো মানুষের ত্বকের কোষ থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে সেটিকে শুক্রাণুর সঙ্গে নিষিক্ত করার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ের মানব ভ্রূণ তৈরির দাবি করেছেন। এই যুগান্তকারী পদ্ধতি বয়স বা রোগজনিত বন্ধ্যাত্বের সমস্যার সমাধান করতে পারে, এমনকি সমলিঙ্গ দম্পতিদেরও নিজেদের জিনগত বৈশিষ্ট্যওয়ালা সন্তান পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
কীভাবে সম্ভব হলো এই ‘অসম্ভব’ সাফল্য?
গবেষণাটি করেছে ‘ওরিগন হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি’ (OHSU)-এর একদল গবেষক। তাদের এই পদ্ধতিটি প্রায় ১৯৯৬ সালে জন্ম নেওয়া ‘ডলি’ (Dolly) নামের ক্লোন করা মেষশাবককে তৈরি করার পদ্ধতির মতোই।
১. নিউক্লিয়াস নিষ্কাশন: গবেষকরা ত্বকের একটি কোষ থেকে নিউক্লিয়াস বের করে আনেন, যেখানে পুরো শরীর গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনগত কোডের একটি সম্পূর্ণ কপি থাকে। ২. মাইটোমিওসিস প্রক্রিয়া: যেহেতু ত্বকের কোষে পুরো ৪৬টি ক্রোমোজোম আগে থেকেই রয়েছে (যা শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হওয়ার জন্য অনুপযোগী), তাই ডিম্বাণুটিকে তার ক্রোমোজোমের অর্ধেক অংশ ফেলে দিতে হয়। গবেষকরা এই প্রক্রিয়াটির নাম দিয়েছেন ‘মাইটোমিওসিস’ (Mitomeiosis)। এর ফলে ডিম্বাণুটি স্বাভাবিক ডিম্বাণুর মতো ২৩টি ক্রোমোজোম ধারণ করে। ৩. ভ্রূণ গঠন: এরপর এই তৈরি হওয়া কার্যকরী ডিম্বাণুকে শুক্রাণুর সঙ্গে নিষিক্ত করানো হলে কিছু ডিম্বাণু প্রাথমিক ভ্রূণ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায়।
বন্ধ্যাত্ব সমস্যার নতুন সমাধান
ওএইচএসইউ-এর অধ্যাপক শৌখরাত মিতালিপোভ বলেছেন, “আমরা এমন এক সাফল্য অর্জন করেছি, যা আগে অসম্ভব বলে ধরা হত।” বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদ্ধতি ভবিষ্যতে বন্ধ্যাত্বের ক্ষেত্রে নতুন সমাধান আনতে পারে:
- বয়স্ক নারীদের জন্য: যাদের দেহে আর কার্যকর ডিম্বাণু নেই, তারা এই পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তান নিতে সক্ষম হতে পারেন।
- পুরুষ বন্ধ্যাত্ব: এমন পুরুষ, যাদের দেহ পর্যাপ্ত শুক্রাণু তৈরি করতে পারে না, এমনকি ক্যান্সারের চিকিৎসার ফলে বন্ধ্যাত্ব হয়েছে— তারাও সাহায্য পেতে পারেন।
- সমলিঙ্গ দম্পতি: এই পদ্ধতি শরীরের প্রায় যেকোনো কোষকে জীবনের সূচনা বিন্দু হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ায় সমলিঙ্গ দম্পতিদেরও নিজেদের জিনগত বৈশিষ্ট্যযুক্ত সন্তান লাভের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
এই পদ্ধতিকে মানব জীববিজ্ঞানে এক উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে প্রশংসা করা হলেও, এটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘নেচার কমিউনিকেশন্স’-এ প্রকাশিত গবেষণাটি বলছে, তৈরি হওয়া কোনো ভ্রূণই ছয় দিনের বেশি বেঁচে থাকতে পারেনি।
এছাড়াও, প্রধান জটিলতা হলো—
- ক্রোমোজোম বিভাজনের ত্রুটি: ডিম্বাণুটি এলোমেলোভাবে সিদ্ধান্ত নেয় কোন ক্রোমোজোম ছেড়ে দেবে। ফলে কখনও কখনও কিছু ক্রোমোজোমের দুটোই থাকে আবার কিছুর একটিও থাকে না— যা রোগ প্রতিরোধ বা সঠিক জিনগত তথ্যের জন্য জরুরি ‘ক্রসিং ওভার’ (Crossing Over) প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে পারে না।
- সাফল্যের হার কম: এই পদ্ধতির সাফল্যের হার মাত্র ৯ শতাংশ।
অধ্যাপক মিতালিপোভের ধারণা, “আমাদের এ প্রযুক্তি নিখুঁত করতে হবে। তবে আমার ধারণা, এটিই হবে ভবিষ্যতের পথ।” বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এই পদ্ধতি বাস্তব চিকিৎসায় ব্যবহারের উপযোগী হতে এক দশক পর্যন্ত লাগতে পারে এবং যথাযথ অনুমোদনের আগে কোনো বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসা কেন্দ্রে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে না।