MiG-21, যুদ্ধের ময়দানে যার দাপটে কেঁপেছে পাকিস্তান, সেই ফাইটার জেট কেন ‘ফ্লাইং কফিন’ নামে পরিচিত হল

৬০ বছরেরও বেশি সময় ভারতীয় বিমানবাহিনীর (IAF) অন্যতম প্রধান যুদ্ধবিমান হিসেবে কাজ করার পর অবশেষে অবসর নিচ্ছে আইকনিক MiG-21। এটি শুধু ভারতের দীর্ঘতম সময় ধরে ব্যবহৃত যুদ্ধবিমানই নয়, এটি বিশ্বের যে কোনও বিমানবাহিনীর অন্যতম দীর্ঘকালীন সার্ভিস দেওয়া যুদ্ধবিমানও বটে। এর অবসর তাই কেবল একটি রুটিন প্রক্রিয়া নয়, বরং ভারতের সামরিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সমাপ্তি।

শুরুর কথা: যখন ভারত MiG-21 বেছে নিল

১৯৬০-এর দশকের শুরুতে ভারত যখন একটি সুপারসনিক জেট খুঁজছিল, তখন পশ্চিমা দেশগুলির দিকে যাওয়ার পথ ছিল সীমিত। আমেরিকা, যারা পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক জোট বেঁধেছিল, তারা ভারতকে উন্নত বিমান দিতে অস্বীকার করে। অন্যদিকে, ব্রিটেনও তাদের লাইসেন্সপ্রাপ্ত লাইটনিং জেট উৎপাদন করার অনুমতি দেয়নি। এই পরিস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে আসে এবং MiG-21-এর প্রস্তাব দেয়, যা ছিল তাদের অন্যতম উন্নত ফাইটার জেট। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, তারা প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং ভারতে স্থানীয়ভাবে এটি তৈরির বিরল সুযোগ দিয়েছিল। এই সিদ্ধান্ত তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণ মেননের কৌশলের সঙ্গে মিলে যায়, যিনি দেশের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতার উপর জোর দিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং পরের বছরই প্রথম MiG-21 ভারতে আসে।

MiG-21-এর বিবর্তন

প্রথমদিকে হালকা ও দ্রুতগতির ইন্টারসেপ্টর হিসেবে তৈরি হলেও, সময়ের সাথে সাথে MiG-21-এর ভূমিকা পরিবর্তিত হতে থাকে। ভারতীয় প্রকৌশলী এবং পাইলটরা এতে কামান, বোমা এবং রকেট যুক্ত করেন। এর পরবর্তী সংস্করণগুলিতে উন্নত রাডার, বেশি জ্বালানির ধারণক্ষমতা এবং বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র যুক্ত করা হয়। এমনকি, আলাদা কোনো রিকনnaissance বিমান না থাকায় এটিতে ব্রিটিশ Vinten ক্যামেরা লাগিয়ে গোয়েন্দা বিমানের কাজও করানো হয়েছিল। ২০০০ সালের শুরুতে এর সর্বশেষ সংস্করণ ‘বাইসন’ আসে, যাতে উন্নত রাডার, ইসরায়েলি ইলেক্ট্রনিক্স এবং অন্যান্য আধুনিক ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়। এই আপগ্রেডের ফলে MiG-21 একটি চতুর্থ প্রজন্মের ফাইটারের ক্ষমতা লাভ করে।

যুদ্ধক্ষেত্রে MiG-21-এর ভূমিকা

১৯৭১ সালের যুদ্ধ: ১৯৭১-এর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন MiG-21 একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ঢাকার তেজগাঁও বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ করে সেটিকে অকেজো করে দেয়, যা বিমানবাহিনীর জন্য আকাশপথে সুবিধা এনে দেয়। এরপর ১৪ ডিসেম্বর, MiG-21-এর চারটি বিমান ঢাকার গভর্নর হাউসে রকেট হামলা চালায়, যা পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্বের আত্মসমর্পণকে ত্বরান্বিত করে।

কারগিল যুদ্ধ: ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধেও MiG-21 গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শত্রুপক্ষের সরবরাহ লাইন, বাঙ্কার এবং সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালায়। এই যুদ্ধের সময় MiG-21 ৫০০টিরও বেশি স্ট্রাইক মিশন এবং ৪৬০টি আকাশ টহল সম্পন্ন করে।

অটলান্টিক ঘটনা ও বালাকোট: ১৯৯৯ সালের ১০ আগস্ট, MiG-21 একটি পাকিস্তানি নৌবাহিনীর Atlantique বিমানকে গুলি করে নামিয়ে দেয়, যেটি ভারতীয় আকাশসীমায় ঢুকে পড়েছিল। এর ২০ বছর পর, ২০১৯ সালে MiG-21 আরও একবার আন্তর্জাতিক শিরোনামে আসে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান একটি MiG-21 বাইসন নিয়ে পাকিস্তানের F-16 যুদ্ধবিমানকে গুলি করে নামিয়ে দেন, যা আধুনিক সামরিক ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা।

কেন ‘ফ্লাইং কফিন’ নামে পরিচিত?

এত অর্জন সত্ত্বেও MiG-21-এর একটি বেদনাদায়ক দিক রয়েছে। বিমানটির উচ্চ অবতরণ গতি, সীমিত ককপিট দৃশ্যমানতা এবং একটি মাত্র ইঞ্জিনের কারণে এটি নতুন পাইলটদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। উন্নত প্রশিক্ষণ বিমানের অভাবে এটিকে প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুসারে, গত ৬০ বছরে ৫০০টিরও বেশি MiG-21 বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে, যাতে ১৭০ জনেরও বেশি পাইলটের মৃত্যু হয়েছে। এই উচ্চ দুর্ঘটনার হারের কারণে এটি ‘ফ্লাইং কফিন’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

একটি যুগের সমাপ্তি

২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ তারিখে MiG-21 আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় বিমানবাহিনী থেকে অবসর নিচ্ছে। এর পরিবর্তে ভারতীয় LCA তেজেস-কে ফ্রন্টলাইনে যুক্ত করা হবে। চণ্ডীগড়ে একটি আনুষ্ঠানিক ফ্লাইপাস্টের মাধ্যমে এই বিমানকে বিদায় জানানো হবে, যেখানে একসময় এর প্রথম স্কোয়াড্রন গঠিত হয়েছিল। এটি কেবল একটি বিমানের অবসর নয়, বরং ভারতের সামরিক ইতিহাস, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং আত্মনির্ভরতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের সমাপ্তি।