ইঁদুর জ্বরের আতঙ্কে জলপাইগুড়ি, রাজগঞ্জের গ্রামে ১৫ জন আক্রান্ত

বর্ষার জমা জলে ছড়ানো ‘ইঁদুর জ্বর’ বা লেপ্টোস্পাইরোসিস-এর আতঙ্কে ভুগছে জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জ। সেখানকার চেতনবাড়ি গ্রামে ইতোমধ্যে ১৫ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে বেশ কিছু শিশুও রয়েছে। আক্রান্তদের নাক, মাড়ি ও প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তপাত এবং ফুসফুসের মারাত্মক সংক্রমণের মতো গুরুতর উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় স্বাস্থ্য দপ্তর ও প্রাণী সম্পদ দপ্তর চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

লেপ্টোস্পাইরোসিস কী এবং কেন ছড়ায়?

লেপ্টোস্পাইরোসিস হলো একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ যা মূলত কুকুর, বিড়াল ও ইঁদুরের মল-মূত্র থেকে ছড়ায়। বর্ষাকালে এই প্রাণীদের বর্জ্য জমা জলে মিশে যায়। সেই দূষিত জল যখন মানুষের সংস্পর্শে আসে, তখন এটি শরীরে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটায়। শরীরে প্রবেশ করার পর ব্যাকটেরিয়া দ্রুত সংখ্যায় বাড়তে থাকে।

রোগের উপসর্গ ও ঝুঁকি

এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হলো তীব্র জ্বর এবং হাত-পায়ে ব্যথা। সাধারণ রক্ত পরীক্ষায় এটি ধরা পড়ে না। চিকিৎসকরা বলছেন, এই রোগ গুরুতর হলে লিভার ও কিডনি বিকল হতে পারে। ফুসফুসে সংক্রমণ, মেনিনজাইটিসের উপসর্গ এবং খিঁচুনিও দেখা দিতে পারে। নাক, মাড়ি এবং প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তপাত এই রোগের গুরুতর লক্ষণ।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যোগীরাজ রায় বলেন, “এটি মূলত পশুদের রোগ, যা বর্ষার জমা জলের মাধ্যমে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হচ্ছে। তাই জমা জল এড়িয়ে চলা খুব জরুরি।”

রাজগঞ্জে রোগের প্রাদুর্ভাব

রাজগঞ্জের চেতনবাড়ি গ্রামে রোগের প্রাদুর্ভাবের পেছনে স্থানীয় একটি হ্যাচারিকে সন্দেহ করা হচ্ছে। সেখানে প্রচুর মুরগির বিষ্ঠা জমা হয়, যার ফলে ইঁদুর ও অন্যান্য প্রাণীর আনাগোনা বেড়েছে। স্বাস্থ্য দপ্তরের বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই ইঁদুরের মূত্র থেকে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে। হ্যাচারি থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।

CMOH ডাঃ অসীম হালদার জানান, সন্ন্য্যাসীকাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের চেকরমারি গ্রামে একটি বড় পোল্ট্রি ফার্ম রয়েছে, যেখানে জমে থাকা মুরগির বিষ্ঠা থেকে প্রচুর ইঁদুর এবং মাছি জন্মাচ্ছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, ওই ইঁদুরের মূত্র থেকে ইঁদুর জ্বর ও স্ক্রাব টাইফাসের মতো রোগ ছড়াতে পারে। তবে তিনি সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

গ্রামবাসীদের ক্ষোভ ও রাজনৈতিক চাপানউতোর

একই পরিবারের একাধিক সদস্য আক্রান্ত হওয়ায় গ্রামবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। তারা বলছেন, সাধারণ জ্বরের কথা ভেবে প্রথমে চিকিৎসা নিতে দেরি হওয়ায় রোগের সংক্রমণ আরও ছড়িয়েছে। স্থানীয় জনবসতির মধ্যে হ্যাচারি গড়ে তোলার অনুমতি দেওয়া নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন তারা। তাদের দাবি, হ্যাচারি বন্ধ না হলে স্থানীয় প্রশাসনকে পদত্যাগ করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে রাজগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক খগেশ্বর রাও গ্রামবাসীদের রোষের মুখে পড়েছেন এবং হ্যাচারি বন্ধের বিষয়ে ‘ম্যাডামকে’ জানাবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।

প্রতিরোধের উপায়

বিশেষজ্ঞরা লেপ্টোস্পাইরোসিস থেকে বাঁচার জন্য কিছু পরামর্শ দিয়েছেন:
১. জমা জল এড়িয়ে চলুন এবং খালি পায়ে জমা জলে হাঁটবেন না।
২. দূষিত জল বা পশুর সংস্পর্শে এলে হাত ও পা ভালো করে সাবান দিয়ে পরিষ্কার করুন।
৩. পশুর প্রস্রাব আছে এমন জায়গায় হাঁটা এড়িয়ে চলুন।
৪. জ্বর ও খিঁচুনির মতো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এই রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়।