২১ জুলাইয়ের মঞ্চে তপ্ত বাকযুদ্ধ, ‘শহীদ দিবস’ বনাম ‘বনভোজন’, সিপিএম-তৃণমূলের তরজা তুঙ্গে

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ২১ জুলাই বরাবরই এক আবেগঘন ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ১৯৯৩ সালে মহাকরণ অভিযানের সময় পুলিশের গুলিতে ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মীর শহিদ হওয়ার স্মৃতিতে তৃণমূল কংগ্রেস এই দিনটিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করে। তবে এই বছর এই বিশেষ দিনটিকে কেন্দ্র করে তৃণমূল এবং সিপিএমের মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক সংঘাত শুরু হয়েছে, যা রাজ্যের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে।
সেলিমের কটাক্ষ: ‘শহীদ দিবস’ নাকি ‘বার্ষিক বনভোজন’?
সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম ২১ জুলাইয়ের তৃণমূলের সমাবেশকে ‘বার্ষিক বনভোজন’ বলে কটাক্ষ করেছেন, যা রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেন, “কলকাতা পুলিশের বদান্যতায় এই সমাবেশ এখন বার্ষিক বনভোজনে পরিণত হয়েছে। আদালত, পুলিশ থেকে শুরু করে তৃণমূল সবাইকে যা খুশি তাই করার অধিকার দিয়েছে।” সেলিমের অভিযোগ, তৃণমূলের সারা বছরের কর্মকাণ্ডে বোমাবাজি, খুন, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে, আর এই সমাবেশ সেই সবের একটি ‘বিরতি’ মাত্র। তিনি ব্যঙ্গ করে আরও বলেন, “এই সমাবেশে শহীদদের নাম নেই, কিন্তু ডিজে আছে।” সেলিম স্পষ্টতই এই সমাবেশের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং এটিকে শহীদদের প্রতি অসম্মান হিসেবে দেখছেন।
মমতার পাল্টা: ‘নরকঙ্কালের দল’ সিপিএম
মহম্মদ সেলিমের কটাক্ষের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কড়া ভাষায় আক্রমণ শানিয়েছেন। ধর্মতলার সমাবেশের প্রাক্কালে তিনি বলেন, “সিপিএমের আমলে রাজ্যে গণতন্ত্র ছিল না। ভোটের নামে ছাপ্পা-রিগিং চলত। আমরা সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। ১৯৯৩ সালে ১৩ জন তরুণ তাদের জীবন দিয়েছিলেন ভোটাধিকারের জন্য। সেই শহীদদের স্মরণে আমরা এই দিন পালন করি।” মমতা সিপিএমকে ‘নরকঙ্কালের দল’ বলেও অভিহিত করেন এবং দাবি করেন যে, তৃণমূলের এই সমাবেশ গণতন্ত্র ও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক। তিনি সিপিএমের সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারের পিছনে কোটি কোটি টাকা খরচের অভিযোগও তোলেন।
সেলিমের প্রতি-উত্তর: ‘মিথ্যাচার’ ও ‘ভয়’
মমতার অভিযোগের জবাবে মহম্মদ সেলিম পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি বলেন সিপিএমের আমলে ভোট দিতে পারতেন না, তাহলে সুব্রত মুখার্জী কী করে মেয়র হলেন? মমতা নিজে কী করে এমপি নির্বাচিত হলেন?” সেলিমের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। সোশ্যাল মিডিয়ায় টাকা খরচের প্রসঙ্গে সেলিম বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়ায় টাকা খরচের কথা বলছেন মমতা। কিন্তু এই কাজে সবচেয়ে এগিয়ে বিজেপি, তারপর তৃণমূল। আমাদের উপর দোষ চাপিয়ে তিনি নিজের ভয় প্রকাশ করছেন।”
২১ জুলাইয়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যুব কংগ্রেস ভোটার পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করার দাবিতে মহাকরণ অভিযানের ডাক দিয়েছিল। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের আমলে এই মিছিলে পুলিশের গুলিতে ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মী প্রাণ হারান। এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে বিবেচিত হয়। পরবর্তীতে মমতা কংগ্রেস ছেড়ে ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন এবং এই দিনটিকে প্রতি বছর ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করতে শুরু করেন, যা আজ তৃণমূলের রাজনৈতিক ক্যালেন্ডারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রাজনৈতিক মহলের নজর:
বিতর্কের মাঝে তৃণমূল এই মঞ্চ থেকে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করার বার্তা দিয়েছে। তবে মহম্মদ সেলিমের ‘বনভোজন’ কটাক্ষ এবং মমতার পাল্টা আক্রমণ ২১ জুলাইয়ের এই সমাবেশকে নিছক একটি রাজনৈতিক সভার পরিবর্তে এক তীব্র বাকযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই বাকযুদ্ধ আগামী দিনে রাজ্য রাজনীতিতে আরও নতুন বিতর্কের জন্ম দেবে।