আয়কর বিল ২০২৫, সিলেক্ট কমিটির যুগান্তকারী সুপারিশ, কর ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের ইঙ্গিত

দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আয়কর বিল, ২০২৫ নিয়ে লোকসভার সিলেক্ট কমিটির বিস্তারিত প্রতিবেদন আজ সংসদে পেশ করলেন কমিটির চেয়ারম্যান বৈজয়ন্ত পান্ডা। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বিলটি লোকসভায় আনার পরই তা পর্যালোচনার জন্য এই বিশেষ কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছিল। বাদল অধিবেশনের প্রথম দিনেই প্রতিবেদন জমা দিয়ে কমিটি তাদের দায়িত্ব সময়মতো সম্পন্ন করার নজির গড়ল।
৩১ সদস্যের এই শক্তিশালী কমিটি বিলের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে ৩২টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুপারিশ করেছে। এই সুপারিশগুলি কেবল সাধারণ করদাতাদের জন্যই নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী বিভিন্ন ক্ষেত্র যেমন আবাসন, স্টার্টআপ, অলাভজনক সংস্থা (এনপিও), ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এমএসএমই), ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্যও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
কমিটির উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলি যা পাল্টে দিতে পারে করের চালচিত্র:
১. সংজ্ঞাগত স্পষ্টতা ও আধুনিকীকরণ:
‘মূলধন সম্পদ’ পুনর্বিবেচনা: বিদেশী প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও বিনিয়োগ তহবিলের ধারণকৃত সম্পদের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে অর্থ আইন, ২০২৫ অনুযায়ী “মূলধন সম্পদ”-এর সংজ্ঞা সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এটি বিনিয়োগ পরিবেশকে আরও স্বচ্ছ করবে।
‘পরিকাঠামো মূলধন কোম্পানি’-এর নতুন দিশা: পুরনো আইনের জটিল ক্রস-রেফারেন্সের জাল ছিঁড়ে নতুন বিলের মধ্যেই “পরিকাঠামো মূলধন কোম্পানি”-এর সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ তৈরির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
MSMED আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য: “মাইক্রো” এবং “ক্ষুদ্র” উদ্যোগের সংজ্ঞা MSMED আইন, ২০০৬-এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করার সুপারিশ করা হয়েছে, যা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য এক স্বস্তিদায়ক খবর।
২. বাড়ির মালিকদের জন্য সুরাহা:
আয় গণনায় সরলীকরণ: ধারা ২২-এর অধীনে গৃহ সম্পত্তি থেকে আয়ের জন্য কর ছাড় গণনার নিয়মাবলী স্পষ্ট করার সুপারিশ করা হয়েছে। এতে ৩০ শতাংশ কর ছাড় পৌর কর ছাড়ের পরে হওয়ার পরামর্শ এবং ভাড়া করা বাড়ির ক্ষেত্রেও নির্মাণের পূর্ববর্তী সুদের ছাড় প্রযোজ্য হওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা লক্ষ লক্ষ বাড়ির মালিকদের জন্য করের বোঝা কমাবে।
৩. বিজ্ঞান গবেষণা ও স্টার্টআপের জন্য উৎসাহ:
গবেষণা ও উন্নয়নে অতিরিক্ত ছাড়: ধারা ৪৫-এ অভ্যন্তরীণ গবেষণা ও উন্নয়নের উপর অতিরিক্ত ছাড় স্পষ্ট করার সুপারিশ করা হয়েছে।
নির্দিষ্ট উপধারাতে গবেষণার অনুমতি: বৈজ্ঞানিক গবেষণার অনুমতি কেবলমাত্র বিশেষ উপধারা ৪৫(৩)(সি)-এর অধীনে প্রযোজ্য হবে, এমন সুপারিশ গবেষণামূলক উদ্যোগগুলিকে উৎসাহিত করবে।
৪. সরকারি পেনশন স্কিমে স্বচ্ছতা:
অস্পষ্টতা দূরীকরণ: ধারা ১২৪(৩)-এ সরকারি পেনশন স্কিমে অবদানের উপর সুস্পষ্ট ছাড় যুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যা পেনশনভোগীদের জন্য নির্ভুলতা নিশ্চিত করবে।
৫. ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের বিশেষ ছাড়:
বেনামী দানের কর পুনর্বিবেচনা: বেনামী দানের উপর কর শুধুমাত্র সম্পূর্ণ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপর আরোপ না করে, ধর্মীয় এবং দাতব্য ট্রাস্টগুলিকেও অব্যাহতি দেওয়ার (ধারা ৩৩৭) সুপারিশ করা হয়েছে, যা এই প্রতিষ্ঠানগুলির কাজকে সহজ করবে।
‘বিবেচিত আবেদন’ ও ‘প্রাপ্তি’র স্পষ্টতা: “বিবেচিত আবেদন” (deemed application) পুনঃপ্রবর্তনের (ধারা ৩৪১) এবং “আয়”-এর পরিবর্তে “প্রাপ্তি” ব্যবহার না করার (ধারা ৩৩৫) পরামর্শ, এই প্রতিষ্ঠানগুলির আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনবে।
৬. ক্ষুদ্র করদাতাদের জন্য বড় স্বস্তি:
ITR দাখিলে অব্যাহতি: যদি কোনও ব্যক্তির আয় করযোগ্য সীমার চেয়ে কম হয় এবং তার আয়ের উপর ইতিমধ্যেই টিডিএস কেটে নেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে ফেরতের জন্য আইটিআর (ITR) দাখিল করার প্রয়োজন নেই (ধারা ২৬৩) বলে সুপারিশ করা হয়েছে। এই পদক্ষেপ লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র করদাতার সময় ও শ্রম বাঁচাবে।
৭. অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন:
‘প্যারেন্ট কোম্পানি’র স্পষ্ট সংজ্ঞা: ধারা ৭১-এ ‘প্যারেন্ট কোম্পানি’-এর একটি স্পষ্ট সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব।
ইলেকট্রনিক পেমেন্টে পেশাদারদের অন্তর্ভুক্তি: ৫০ কোটি টাকার বেশি আয়ের জন্য ইলেকট্রনিক পেমেন্টের নিয়মে পেশাদারদেরও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত (ধারা ১৮৭) বলে সুপারিশ করা হয়েছে।
সমবায় ব্যাঙ্কের সংজ্ঞা: সমবায় ব্যাঙ্কের সংজ্ঞা বিলটিতে (ধারা ১৮৯) অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব।
প্রভিডেন্ট ফান্ড টিডিএস নিয়মে ‘অবাধ্য’ ধারা: প্রভিডেন্ট ফান্ড টিডিএস নিয়মে “অবাধ্য” ধারাটি যুক্ত করার প্রস্তাব (ধারা ৩৯২)।
শূন্য কর ছাড় সার্টিফিকেটের বৈধতা: শূন্য কর ছাড় সার্টিফিকেটের বৈধতা স্পষ্ট করার প্রস্তাব (ধারা ৩৯৫)।
এই সুপারিশগুলি যদি আইনে পরিণত হয়, তবে তা দেশের কর ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক, স্বচ্ছ এবং করদাতাদের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ করে তুলবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি শুধু কর সংগ্রহের পদ্ধতিকেই উন্নত করবে না, বরং ব্যবসা এবং বিনিয়োগের পরিবেশকেও আরও অনুকূল করে তুলবে।