ইয়েমেনে নিমিশা প্রিয়ার ফাঁসির দড়ি, ভারতের কূটনৈতিক দৌড়, কিন্তু নিহত পরিবারের অনড় অবস্থান!

ইয়েমেনের রাজধানী সানার সেন্ট্রাল জেলে ভারতীয় নার্স নিমিশা প্রিয়ার জীবন এখন সুতার উপর ঝুলছে। খুনের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই কেরলের তরুণীকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে বাঁচাতে মরিয়া ভারত সরকার। ১৬ই জুলাই তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও, ভারতের নিরন্তর কূটনৈতিক তৎপরতায় তা আপাতত স্থগিত হয়েছে। তবে নিহতের পরিবারের অনড় অবস্থান, ‘ব্লাড মানি’ গ্রহণে অস্বীকৃতি – এই জটিল পরিস্থিতি উদ্ধার অভিযানকে আরও কঠিন করে তুলছে।
ভারতের জোরদার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা:
বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বৃহস্পতিবার জানান, সরকার এই ‘সংবেদনশীল’ বিষয়ে প্রিয়ার পরিবারকে সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে। তিনি বলেন, “আমরা আইনি সহায়তা দিয়েছি এবং একজন আইনজীবী নিয়োগ করেছি, যিনি পরিবারের পাশে রয়েছেন। নিয়মিত কনসুলার পরিদর্শনের ব্যবস্থাও করেছি এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি।”
জয়সওয়াল আরও জানান যে, “সাম্প্রতিক দিনে বিশেষভাবে চেষ্টা করা হয়েছে যাতে পরিবারের সদস্যরা নিহতের পরিবারের সঙ্গে একটি পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে পারেন।” তিনি নিশ্চিত করেন যে, ইয়েমেনের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ১৬ই জুলাই হওয়ার কথা থাকা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত করেছে। ভারত সরকার বিষয়টি ‘নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ’ করছে এবং কয়েকটি বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখা হচ্ছে প্রিয়ার জীবন বাঁচাতে।
ঘটনার সূত্রপাত এবং আত্মরক্ষার দাবি:
কেরলের পালক্কাড জেলার বাসিন্দা নিমিশা প্রিয়াকে ২০১৭ সালে এক ইয়েমেনি নাগরিক তালাল আব্দো মেহদিকে মাদক দিয়ে হত্যা করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযোগ ওঠে, তিনি আরেকজন নার্সের সাহায্যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। তবে নিমিশা এই অভিযোগ অস্বীকার করে আত্মপক্ষ সমর্থনে দাবি করেন যে, মেহদি তাঁকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেন এবং তাঁর পাসপোর্ট ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। পাসপোর্ট ফেরত পাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি মেহদিকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিলেন, কিন্তু তাতে অতিরিক্ত মাত্রায় ওষুধ সেবনের ফলে তাঁর মৃত্যু হয়।
দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া এবং মৃত্যুদণ্ডের অনুমোদন:
নিমিশা প্রিয়া ২০০৮ সাল থেকে ইয়েমেনে নার্স হিসেবে কাজ করছেন। ২০১১ সালে স্বামী টমি থমাস ও কন্যা সন্তানের সঙ্গে তিনি সেখানে যান। ২০১৪ সালে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর স্বামী ও কন্যা ভারতে ফিরে আসেন, কিন্তু প্রিয়া সেখানেই থেকে যান।
পরবর্তীতে, নিমিশা প্রিয়া এক ইয়েমেনি মেহদির সঙ্গে যৌথভাবে একটি নার্সিং হোম চালু করেন। তাঁদের মধ্যে ব্যবসায়িক বিষয়ে বিতর্কের জেরেই মেহেদির অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। তদন্তে নিমিশা দোষী প্রমাণিত হন। ২০২০ সালে ইয়েমেনের একটি স্থানীয় আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। এরপর তাঁর সব ধরনের আইনি আপিল খারিজ হয়ে যায়। ২০২৩ সালে ইয়েমেনের সুপ্রিম কোর্টও তাঁর আপিল বাতিল করে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে হুতি গোষ্ঠীর শাসক মাহদি আল-মাশাত মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অনুমোদন দেন।
‘ব্লাড মানি’র প্রতিবন্ধকতা:
ইয়েমেনে ইসলামিক আইন প্রচলিত। এই নিয়মে ‘রক্তের মূল্য’ (দিয়া) অর্থাৎ নিহতের পরিবার আর্থিক ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করলে ফাঁসি রদ হতে পারে। তবে এটাই নিমিশা প্রিয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিহত তালাল মেহদির পরিবার পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা ক্ষমা বা আর্থিক ক্ষতিপূরণ কিছুই গ্রহণ করবে না এবং নিমিশা প্রিয়াকে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত।
ভারতের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা একদিকে, আর নিহতের পরিবারের অনড় অবস্থান অন্যদিকে – এই দুইয়ের টানাপোড়েনে নিমিশা প্রিয়ার ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত। সময় যত গড়াচ্ছে, তত বাড়ছে উদ্বেগ।