আহমেদাবাদ বিমান দুর্ঘটনা! ককপিটে শেষ মুহূর্তের ভয়াবহ কথোপকথন, ধোঁয়াশা ঘেরা ১৫ পাতার প্রাথমিক রিপোর্ট

গত ২ জুন আহমেদাবাদে লন্ডনগামী এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট AI171 বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনারের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ২৬০ জন। রানওয়ে থেকে উড্ডয়নের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিমানটি শহরের বিজে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ওপর ভেঙে পড়ে। আজ সেই মর্মান্তিক ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ভারতের এয়ারক্রাফ্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (AAIB)।

১৫ পাতার এই প্রাথমিক রিপোর্টে এমন কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে, যা কেবল হতবাকই করে না, বরং এই প্রশ্ন তুলে ধরে যে, এই দুর্ঘটনা নিছকই প্রযুক্তিগত ত্রুটি ছিল, নাকি এর পেছনে ছিল ভুল বোঝাবুঝি বা গুরুতর গাফিলতি?

কী ছিল সেই শেষ মুহূর্তে?
দুর্ঘটনার কয়েক সেকেন্ড আগে ককপিট ভয়েস রেকর্ডারে ধরা পড়ে এক পাইলটের উদ্বেগভরা প্রশ্ন: “তুমি ফুয়েল কাট অফ কেন করলে?” জবাবে অন্য পাইলট বলেন, “আমি করিনি।” এই সংক্ষিপ্ত অথচ ভয়াবহ কথোপকথনের পরই মুহূর্তের মধ্যে সব শেষ হয়ে যায়।

AAIB জানিয়েছে, উড্ডয়নের পরপরই বিমানের দুই ইঞ্জিনের ফুয়েল কাট-অফ সুইচ একসঙ্গে ‘RUN’ (চালু) অবস্থা থেকে ‘CUTOFF’ (বন্ধ) অবস্থায় চলে যায়। এর ফলে মাঝ আকাশে বন্ধ হয়ে যায় দুই ইঞ্জিনের জ্বালানি সরবরাহ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই থ্রাস্ট থেমে যায়, বিমান গতি ও উচ্চতা হারাতে থাকে, এবং তারপরই ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ।

AAIB রিপোর্টের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এক নজরে:
১. ইঞ্জিন বন্ধ: উড্ডয়নের ঠিক পরেই দুই ইঞ্জিনের ফুয়েল কাট-অফ সুইচ একসঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে ইঞ্জিনের শক্তি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
২. ককপিটে বিভ্রান্তি: ককপিট ভয়েস রেকর্ডার থেকে জানা যায়, পাইলটদের মধ্যে ফুয়েল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল; কেউই এই সিদ্ধান্তের দায় স্বীকার করেননি।
৩. প্রাণহানি: বিমানটি মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের উপর আছড়ে পড়ে। এতে ২৪১ জন যাত্রী ও ক্রু সদস্যের এবং হোস্টেলের ছাদে ক্যান্টিনে থাকা ১৯ জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়।
৪. সর্বোচ্চ গতি ও ইঞ্জিন বন্ধ: বিমানের সর্বোচ্চ গতি ছিল ১৮০ নট। এর ঠিক পরেই ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আর ঘুরে দাঁড়ানোর সময় পায়নি AI171।
৫. বিদ্যুৎ বিপর্যয়: সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে যে Ram Air Turbine (RAT) নিজে থেকেই সক্রিয় হয়ে গেছে — এটি কেবল বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেই ঘটে।
৬. ইঞ্জিন চালু করার চেষ্টা: দুটি ফুয়েল সুইচ আবার ‘RUN’ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হলেও, কেবল ইঞ্জিন ২ কিছু সময়ের জন্য কাজ করেছিল। ইঞ্জিন ১ আর কোনোভাবেই চালু করা যায়নি।
৭. বার্ড স্ট্রাইকের চিহ্ন নেই: তদন্তকারীরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, বিমানে কোনো বার্ড স্ট্রাইকের চিহ্ন মেলেনি। ফলে এটি দুর্ঘটনার কারণ নয়।
৮. থ্রটল সেটিং: থ্রটল শুরু থেকে টেকঅফ সেটিংয়ে ছিল। তবে দুর্ঘটনার পরে এটি ‘আইডল’ অবস্থায় পাওয়া গেছে, যা সম্ভবত তাপজনিত ক্ষতির ফল।
৯. রেকর্ডারের অবস্থা: বিমানের সামনের ‘Extended Airframe Flight Recorder’ থেকে তথ্য উদ্ধার সম্ভব হয়েছে। তবে পিছনের রেকর্ডারটি ক্ষতিগ্রস্ত।
১০. সতর্কতা জারি হয়নি: এই মুহূর্তে বোয়িং বা GE (ইঞ্জিন নির্মাতা) এর প্রতি কোনো সতর্কবার্তা জারি হয়নি। দুর্ঘটনার মূল কারণ এখনও চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়নি।

প্রযুক্তিগত ত্রুটি, নাকি মানবিক ভুল?
প্রাথমিকভাবে বোঝা যাচ্ছে, ফুয়েল কাট-অফ সুইচ বন্ধ হয়ে যাওয়া ছিল এই দুর্ঘটনার মূল ট্রিগার। কিন্তু কে বা কী এর জন্য দায়ী? পাইলটের ভুল? ইলেকট্রনিক ত্রুটি? নাকি কোনো পদ্ধতিগত ত্রুটি?

AAIB এখনও তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। তবে রিপোর্টের প্রতিটি লাইনেই স্পষ্ট – দ্রুত প্রতিক্রিয়ার অভাব, প্রযুক্তিগত সচেতনতা ও স্পষ্ট যোগাযোগের ঘাটতি মিলিয়েই তৈরি হয়েছিল এই ভয়াবহ পরিস্থিতি।