
মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে আজ কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (ISS) উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন ভারতীয় বায়ুসেনার গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লা। স্পেসএক্সের তৈরি অত্যাধুনিক ফ্যালকন-৯ রকেট এবং ড্রাগন মহাকাশযানে চেপে মহাজাগতিক পথে তাঁর এই ঐতিহাসিক উড়ান, ভারতকে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেল। ভারত, পোল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং হাঙ্গেরির মহাকাশচারীদের সমন্বয়ে গঠিত অ্যাক্স-৪ মিশনটি আগামী ১৪ দিন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অংশ নেবে। এই অভিযানের সাফল্যের মূলে রয়েছে আধুনিক মহাকাশ প্রযুক্তির বিস্ময়কর মেলবন্ধন।
ফ্যালকন-৯: স্পেসএক্সের পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তিঘর
এই মিশনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল এলন মাস্কের স্পেসএক্স কোম্পানির ফ্যালকন-৯ রকেট। এটি শুধুমাত্র একটি উৎক্ষেপণ যান নয়, এটি মহাকাশ পরিবহনে পুনর্ব্যবহারযোগ্যতার এক সফল উদাহরণ। ফ্যালকন-৯ একটি আংশিকভাবে রিইউজেবল, দুই-পর্যায়ের মিডিয়াম-লিফট রকেট। দৈর্ঘ্যে প্রায় ৭০ মিটার এবং ৫৪৯ মেট্রিক টনেরও বেশি ওজনের এই যানটি তার প্রথম পর্যায়ে ৯টি ‘মার্লিন’ ইঞ্জিন দ্বারা চালিত হয়, যা তরল অক্সিজেন এবং রকেট-গ্রেড কেরোসিনের মিশ্রণে শক্তি উৎপন্ন করে। ফ্যালকন-৯-এর অনন্য বৈশিষ্ট্য হল উৎক্ষেপণের পর এর প্রথম পর্যায়ের বুস্টারের উল্লম্বভাবে পৃথিবীতে ফিরে এসে অবতরণ করার ক্ষমতা। এই উদ্ভাবনী প্রযুক্তি পরবর্তী মিশনগুলির খরচ বহুলাংশে কমিয়ে আনে। উল্লেখ্য, শুভাংশু শুক্লাদের মিশনের জন্য ব্যবহৃত বুস্টারটি এর আগেও সফলভাবে স্টারলিঙ্ক-এর একটি স্যাটেলাইটকে মহাকাশে স্থাপন করে পৃথিবীতে ফিরে এসেছিল, যা এর নির্ভরযোগ্যতা এবং কার্যকারিতা প্রমাণ করে।
ড্রাগন মহাকাশযান: নভোচারী ও পণ্যের নিরাপদ আশ্রয়
ফ্যালকন-৯ রকেটের অগ্রভাগে যুক্ত ‘ড্রাগন’ মহাকাশযানটি মহাকাশচারী এবং প্রয়োজনীয় পণ্য আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পরিবহনের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। এটি শুধুমাত্র যাত্রী বহনকারী ক্যাপসুল নয়, এটি অত্যাধুনিক লাইফ-সাপোর্ট সিস্টেম, স্পর্শ-সংবেদনশীল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (টাচস্ক্রিন কন্ট্রোল) এবং একটি বিশাল কার্গো বে দ্বারা সজ্জিত। ড্রাগন মহাকাশযান স্বয়ংক্রিয়ভাবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের সঙ্গে ডক করতে সক্ষম, যা মহাকাশে সংযুক্তি প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত মসৃণ করে তোলে। মিশন শেষে, মহাকাশচারীদের নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার জন্য এটি সমুদ্রে সুরক্ষিত অবতরণেরও ব্যবস্থা রয়েছে।
অ্যাক্স-৪ মিশন: আন্তর্জাতিক সহযোগিতার এক ঝলক
অ্যাক্স-৪ মিশনে শুভাংশু শুক্লার নেতৃত্বে রয়েছেন নাসার প্রাক্তন নভশ্চর এবং অ্যাক্সিয়ম স্পেসের মানব মহাকাশযানের ডিরেক্টর রেগি হুইটসন। তাঁর অভিজ্ঞতা এই মিশনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও, পোল্যান্ডের স্লায়োস উজ়নানস্কি-উইসনিউস্কি এবং হাঙ্গেরির টিবর কাপু এই আন্তর্জাতিক দলের অংশ। এই মহাকাশচারীরা ১৪ দিনের আইএসএস মিশনে অন্তত ৬০টি বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা চালাবেন, যা মহাকাশ জীববিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে নতুন তথ্য উন্মোচন করতে পারে।
গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লার এই যাত্রা কেবল ভারতের মহাকাশ উচ্চাকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন নয়, এটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অপার সম্ভাবনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা মানবজাতির মহাকাশ অন্বেষণের পথকে আরও প্রশস্ত করবে।