কালীগঞ্জে মৃত নাবালিকার মায়ের ক্ষোভের মুখে পুলিশ, সিবিআই তদন্তের দাবি জোরালো

কালীগঞ্জ উপনির্বাচনের ফল প্রকাশের দিন তৃণমূলের বিজয় মিছিল থেকে ছোঁড়া বোমায় নিহত ১৪ বছরের নাবালিকার ঘটনায় উত্তাল রাজ্য রাজনীতি। মেয়ের মৃত্যুতে শোকের পরিবর্তে ক্ষোভে ফুঁসছেন মা সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি পুলিশের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করে সরাসরি সিবিআই তদন্তের দাবি তুলেছেন, এবং পুলিশের সমবেদনা জানাতে যাওয়া কর্মকর্তাদের প্রকাশ্যে অপদস্থ করেছেন।

মঙ্গলবার (আজকের তারিখ অনুযায়ী) কালীগঞ্জের মীর ফাঁড়ির পুলিশ আধিকারিকরা নিহত নাবালিকার বাড়িতে পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সন্তানহারা মা সাবিনা ইয়াসমিন পুলিশের এই প্রচেষ্টায় বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। তিনি পুলিশ কর্তাদের মুখের ওপর তীব্র ক্ষোভ উগরে দেন। সাবিনা পুলিশ সুপার অমরনাথ দে-কেও উদ্দেশ্য করে বলেন, “আপনাদের তো শেখানো হয়েছে ঝামেলা লাগুক, শিশুর প্রাণ যাক। কিছুই করবেন না। আপনাদের কাউকে জবাব দিতে হয় না। আপনি আমাকে জবাব দিন। আমার সন্তান ফেরত চাই।” তিনি আরও বলেন, “কোনও ক্ষমতা নেই আপনাদের। কিছু করতে পারবেন না।”

নদিয়ার পুলিশ সুপার অমরনাথ দে সাবিনাকে শান্ত করার এবং পুলিশের ওপর আস্থা রাখার অনুরোধ করলে, তিনি আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। সাবিনা বলেন, পুলিশের ক্ষমতা থাকলে গোটা এলাকা শান্ত থাকত, তাদের সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ছাড়া হতে হত না। তিনি জানান, তিনি বোনের বাড়ি চলে যেতেন, কিন্তু মেয়ের অনলাইনে অর্ডার করা জিনিস আসার কথা থাকায় তারা থেকে গিয়েছিলেন, আর তাতেই এই ভয়ঙ্কর পরিণতি হল।

যদিও পুলিশ অপরাধীদের গ্রেফতার করে শাস্তির আশ্বাস দিয়েছে, সাবিনা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, পুলিশ কিছুই করবে না। অপদস্ত হয়েই পুলিশ দ্রুত এলাকা ছেড়ে চলে যায়। পরে পুলিশ সুপার জানান, সদ্যই মহিলা সন্তান হারিয়েছেন, তাই তাঁর মানসিক পরিস্থিতি ঠিক নেই, এজাতীয় কথা বলাই স্বাভাবিক।

সাবিনা ইয়াসমিন অভিযোগ করেছেন যে, তারা সিপিএম-এর ভোটার হওয়ার কারণেই তাদের মেয়ের ওপর পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয়েছে। যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং দোষীদের শাস্তির আশ্বাস দিয়েছেন। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত এই ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থীর জয় নিশ্চিত হতেই স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব বিজয় মিছিল বের করে। অভিযোগ, সেই মিছিল থেকেই সিপিএম কর্মীর বাড়ি লক্ষ্য করে বোমা ছোঁড়া হয়, যার ফলে ১৪ বছরের নাবালিকার মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পরই গোটা এলাকায় তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

কালীগঞ্জের এই ঘটনা কেবল একটি মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড নয়, এটি রাজনৈতিক হিংসা, প্রশাসনিক অনাস্থা এবং বিচার চাওয়ার তীব্র আকুতির এক জটিল চিত্র। সাবিনা ইয়াসমিনের ক্ষোভের সামনে পুলিশের অসহায়ত্ব রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

বিশ্লেষণমূলক সংবাদ প্রতিবেদন
কালীগঞ্জের ‘আস্থা সংকট’: বোমা হামলায় নিহত নাবালিকার মায়ের বিস্ফোরক অভিযোগ, পুলিশের কার্যকারিতা ও রাজনৈতিক হিংসার আবর্তে বিচার

কালীগঞ্জ উপনির্বাচনের বিজয় মিছিল ঘিরে রাজনৈতিক হিংসার যে বীভৎসতা দেখা গেল, তার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন এক ১৪ বছরের নাবালিকার মর্মান্তিক মৃত্যু। এই ঘটনার পর নিহত নাবালিকার মা সাবিনা ইয়াসমিনের অকুণ্ঠ ক্ষোভ এবং পুলিশের প্রতি তাঁর চরম অনাস্থা, রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক পরিবেশের এক নগ্ন চিত্র তুলে ধরেছে। পুলিশ কর্তারা সমবেদনা জানাতে গিয়েও যে অপদস্থ হয়েছেন, তা প্রমাণ করে সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট কতটা গভীর।

পুলিশ আধিকারিকদের, এমনকি স্বয়ং পুলিশ সুপারকে, একজন সন্তানহারা মায়ের সামনে অপদস্ত হতে দেখা অত্যন্ত বিরল এবং এটি পুলিশের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তোলে। সাবিনা ইয়াসমিনের উক্তি, “আপনাদের তো শেখানো হয়েছে ঝামেলা লাগুক, শিশুর প্রাণ যাক। কিছুই করবেন না। আপনাদের কাউকে জবাব দিতে হয় না। আপনি আমাকে জবাব দিন। আমার সন্তান ফেরত চাই,”—এটি নিছকই এক মায়ের ব্যক্তিগত শোকের প্রকাশ নয়, বরং এটি সমাজের বৃহত্তর অংশের পুলিশের প্রতি আস্থার অভাবের প্রতিধ্বনি। যখন পুলিশ “অপরাধীদের পাকড়াও করে শাস্তি দেবে” বলে আশ্বাস দেয়, তখন সরাসরি “পুলিশ কিছুই করবে না” বলে সেই আশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করা, এটি একটি ব্যবস্থার প্রতি চরম অনাস্থার ইঙ্গিত।

সাবিনা ইয়াসমিনের অভিযোগ যে তারা সিপিএম ভোটার হওয়ার কারণে তাদের মেয়ের ওপর ‘পরিকল্পিতভাবে হামলা’ হয়েছে, তা বাংলার রাজনৈতিক হিংসার এক ভয়াবহ দিক উন্মোচন করে। উপনির্বাচনের বিজয় মিছিল থেকে বোমা ছোঁড়া এবং একজন নাবালিকার মৃত্যু, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নামে হিংসার চরম বহিঃপ্রকাশ। এই ঘটনা কেবল একটি ব্যক্তি বা পরিবারের ট্র্যাজেডি নয়, এটি সেই সংস্কৃতি যেখানে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানো এবং আক্রমণ করার জন্য সহিংসতাকে ব্যবহার করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুঃখ প্রকাশ’ এবং ‘দোষীদের শাস্তি’র আশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটা রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

সাবিনা ইয়াসমিনের এই বক্তব্য যে তিনি মেয়ের অনলাইন অর্ডারের অপেক্ষায় থেকে গিয়েছিলেন এবং তার জন্যই মেয়ের এই পরিণতি হলো, তা এই ঘটনার মানবিক সংকটকে আরও মর্মান্তিকভাবে তুলে ধরে। একটি সামান্য অনলাইন অর্ডারের অপেক্ষা কিভাবে একটি জীবন কেড়ে নিতে পারে, তা রাজনৈতিক হিংসার নির্লিপ্ততাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

কালীগঞ্জের এই ঘটনা কেবল একটি অপরাধ নয়, এটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক গভীর ক্ষত। নিহত নাবালিকার মায়ের প্রকাশ্য অনাস্থা রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার ওপর আস্থার অভাবকে স্পষ্ট করেছে। এই ঘটনা কি কেবল কয়েকটি গ্রেফতারির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি এটি রাজনৈতিক হিংসার বিরুদ্ধে এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে সরকারকে বাধ্য করবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। একটি নিরপরাধ শিশুর মৃত্যু যেন নিছকই একটি সংখ্যা হয়ে না থাকে, বরং তা বিচারের দাবি এবং হিংসামুক্ত সমাজের আকাঙ্ক্ষাকে আরও জোরালো করে তোলে।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy