
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভূতপূর্ব নির্দেশে ইরানের তিনটি সামরিক ঘাঁটিতে মার্কিন বিমান বাহিনীর হামলা মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের আশঙ্কাকে আরও গভীর করেছে। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর এই প্রথম কোনো পশ্চিমা দেশ ইরানের মাটিতে সরাসরি সামরিক আঘাত হানল, যা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এখন বিশ্ব তাকিয়ে আছে ইরানের প্রতিক্রিয়ার দিকে, যেখানে হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি এক মারাত্মক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
হরমুজ প্রণালী, যা মাত্র ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং স্থানভেদে ৩ থেকে ৩৯ কিলোমিটার পর্যন্ত চওড়া, একদিকে ইরান এবং অন্যদিকে ওমান দ্বারা বেষ্টিত। এই কৌশলগত জলপথ পারস্য উপসাগরকে আরব সাগর ও ওমান উপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। এটি বিশ্ব বাণিজ্যের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধমনী। প্রতিদিন এই প্রণালী দিয়ে প্রায় ২ কোটি ব্যারেল তেল এবং সমপরিমাণ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পরিবাহিত হয়। বৈশ্বিক জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মোট সরবরাহের প্রায় এক পঞ্চমাংশ এই হরমুজ প্রণালী দিয়েই চলাচল করে।
জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বাজার পর্যবেক্ষক সংস্থা ভোরটেক্সা’র তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন ১ কোটি ৭৮ লাখ থেকে ২ কোটি ৮ লাখ ব্যারেল পরিশোধিত-অপরিশোধিত জ্বালানি তেল এবং LNG এই জলপথ ব্যবহার করেছে। ওপেক সদস্য রাষ্ট্র যেমন সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত এবং ইরাক তাদের বেশিরভাগ তেল হরমুজ প্রণালী ব্যবহার করে এশিয়ার দেশগুলোতে পাঠায়। এই গুরুত্বপূর্ণ পথে চলাচলকারী বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ৫ম নৌবহর।
ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করলে কী হবে?
যদি ইরান সত্যিই হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়, তবে বিশ্ববাজারে এর ব্যাপক ও ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। বিশ্বজুড়ে দৈনিক তেল সরবরাহের এক-পঞ্চমাংশ হঠাৎ করে কমে গেলে তেলের দাম আকাশচুম্বী হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে এক ভয়াবহ মন্দা ডেকে আনতে পারে।
তবে, বিশ্লেষকদের মতে, এমন পদক্ষেপ ইরানের জন্য ‘আত্মঘাতী’ হতে পারে। কারণ, জ্বালানি তেলের ওপর মারাত্মকভাবে নির্ভরশীল ইরানের তেলও এই জলপথ দিয়েই বিশ্বে রফতানি হয়। তাছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো, যারা বর্তমান ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে ইরানের প্রতি সহানুভূতিশীল, তারাও হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে ইরান থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতে পারে। শুধু উপসাগরীয় দেশগুলোই নয়, এই জলপথ বন্ধ হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে চীন। চীন ইরানের তেলের বৃহত্তম ক্রেতা; ইরানের মোট উৎপাদিত তেলের ৯০ শতাংশই চীনে যায়।
ইরানের ভাবনা এবং আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ:
রোববার ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন চ্যানেল প্রেস টিভি জানিয়েছে যে, ইরানের পার্লামেন্ট ‘মজলিশ’-এ হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া বিষয়ক একটি বিল পাস হয়েছে। তবে, এ ইস্যুতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিই দেবেন।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ আব্বাস আরাগচি রোববার জানিয়েছেন, ইরানে মার্কিন বাহিনীর বোমাবর্ষণের জন্য ‘গুরুতর পরিণতি’ ভোগ করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মার্কো রুবিও জানিয়েছেন যে, ওয়াশিংটন ইরানকে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা থেকে বিরত রাখতে চীনের সহযোগিতা চেয়েছে। সোমবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজকে তিনি বলেছেন, “যদি তারা সত্যিই হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়— তাহলে তা হবে একটি ভয়াবহ ভুল পদক্ষেপ এবং একই সঙ্গে তাদের নিজেদের জন্য অর্থনৈতিক আত্মহত্যা। কারণ এই প্রণালী দিয়ে তাদের তেলও পরিবহন করা হয়।” তিনি আরও যোগ করেন, “আমি বেইজিংকে এ ইস্যুতে ইরানের সঙ্গে কথা বলার আহ্বান জানিয়েছি। কারণ তারা ইরানের তেলের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।”
বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্য এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে দাঁড়িয়ে। আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিশীলতা এখন হরমুজ প্রণালীর ওপর ঝুলে আছে, এবং ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে বিশ্ববাসীর কড়া নজর।