রক্তাক্ত লাভপুর, বোমা বাঁধতে গিয়ে ছিন্নভিন্ন ২, নেপথ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও ‘নকল কয়েন’ সাম্রাজ্য!

বীরভূমের লাভপুর আবারও রক্তাক্ত। এবার হাতিয়া গ্রামে বোমা বাঁধতে গিয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ২ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের নাম পিয়ার আলি ও সাবের আলি, যার মধ্যে একজন স্থানীয় তৃণমূল নেতার ছেলে বলে জানা গেছে। আহত হয়েছেন আরও এক দুষ্কৃতী। এই ঘটনা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, এবং এর পেছনে ক্ষমতা ও ‘নকল কয়েন’ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অভিযোগ উঠেছে।

গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বলি: কাঠগড়ায় শাসকদল
ঘটনাটি ঘটেছে তৃণমূলের কোর কমিটির বৈঠকের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে, যা রাজনৈতিক মহলে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। লাভপুরের হাতিয়া গ্রামে এলাকা দখলকে কেন্দ্র করে দুই দল দুষ্কৃতীর মধ্যে ব্যাপক বোমাবাজি চলছিল বলে অভিযোগ। গ্রামবাসীর একাংশের স্পষ্ট দাবি, এটি তৃণমূলের দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ের ফল। একদিকে জেলা সভাধিপতি কাজল শেখের গোষ্ঠী, অন্যদিকে লাভপুরের বিধায়ক অভিজিৎ সিংহের ঘনিষ্ঠ আব্দুল মান্নান গোষ্ঠী। এই দুই গোষ্ঠীর বিবাদের জেরেই বোমা বাঁধতে গিয়ে বিস্ফোরণ এবং প্রাণহানি ঘটেছে বলে অভিযোগ।

‘নকল কয়েন’ সাম্রাজ্যের ছায়া: দীর্ঘদিনের পুরনো দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত পরিণতি
হাতিয়া গ্রাম শুধু লাভপুর নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে ‘নকল সোনার কয়েন’ বিক্রির জন্য কুখ্যাত। লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার এই অবৈধ কারবার কাদের দখলে থাকবে, তা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে দুই দল দুষ্কৃতীর মধ্যে লড়াই চলছিল। হাতিয়ার বুথ সভাপতি শেখ মইনুদ্দিন ও তার সহযোগী শেখ মুস্তাফি বনাম নকল কয়েন বিক্রেতাদের মাথা শেখ মনিরের দ্বন্দ্ব ছিল এই সংঘাতের মূলে।

সূত্রের খবর, মাস ছয়েক ধরে ফেরার থাকার পর শুক্রবার সন্ধ্যায় শেখ মইনুদ্দিন ও শেখ মুস্তাফি গ্রামে ঢোকার চেষ্টা করেন। অভিযোগ, শুরুতেই তাদের আটকে দেয় শেখ মনিরের লোকজন। হাতিয়া বাস স্ট্যান্ডের কাছে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল মারামারি শুরু হয়। এরপর দফায় দফায় গ্রামে ঢোকার চেষ্টা এবং বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। শনিবার সকাল ৭টায় আবার দলবল নিয়ে গ্রামে ঢুকতে যায় তারা। সেই সময় গ্রামেরই ছাতিম পুকুরের পাড়ে বসে মনিরের দলবল বোমা বাঁধছিল, আর তখনই ঘটে মর্মান্তিক বিস্ফোরণ।

বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন দেহ, পুলিশের বিবৃতি
পুলিশ সূত্রে খবর, ওই বিস্ফোরণে দুষ্কৃতীদের ছিন্নভিন্ন দেহ উদ্ধার হয়েছে। পুলিশ সুপার আমন দীপ জানান, “বোমা বাঁধতে গিয়ে দু’জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। তদন্ত শুরু হয়েছে।” পুলিশ মৃতদেহ দুটি ময়নাতদন্তে পাঠিয়েছে এবং আহত দুষ্কৃতীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

অস্ত্র কারখানা ও পুলিশের ওপর হামলা: হাতিয়ার কলঙ্কিত ইতিহাস
গত বছর মার্চে এই এলাকাতেই একটি নকল অস্ত্র কারখানার সন্ধান পেয়েছিল লাভপুর থানার পুলিশ। সেই সময় ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ আক্রান্ত হয়, এমনকি তাদের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে বাধ্য হয়ে শূন্যে গুলি চালাতে হয়। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ফের এই বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা হাতিয়াকে আবারও শিরোনামে নিয়ে এল, যা এই গ্রামের অন্ধকার দিকটিকেই বারবার সামনে আনছে। এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং এই ধরনের অবৈধ কারবার নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন কতটা সক্ষম, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বারবার।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy