
যে ঘরের চার দেওয়ালকে আমরা ব্যক্তিগত কথোপকথন এবং পারিবারিক আড্ডার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করি, ডিজিটাল যুগের বাস্তবতা এবার সেই ধারণাতেই আঘাত হানছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য: আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত ল্যাপটপ, স্মার্ট স্পিকার এমনকি হেডফোনের মতো সাধারণ ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোও অজান্তেই আপনার ব্যক্তিগত কথা ফাঁস করে দিচ্ছে হ্যাকারদের কাছে!
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডা এবং জাপানের ইউনিভার্সিটি অব ইলেকট্রো-কমিউনিকেশনসের গবেষকেরা সম্প্রতি একটি নতুন নিরাপত্তা ত্রুটি (সিকিউরিটি ফ্ল) খুঁজে পেয়েছেন, যা বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য এক বড় বিপদ সংকেত বয়ে এনেছে।
কীভাবে ফাঁস হচ্ছে ব্যক্তিগত কথোপকথন?
গবেষণায় দেখা গেছে, ল্যাপটপ, স্মার্ট স্পিকারসহ বিভিন্ন ধরনের সাধারণ ইলেকট্রনিক ডিভাইসে থাকা মাইক্রোফোন থেকে অনিচ্ছাকৃতভাবে কিছু রেডিও সিগন্যাল (বেতার তরঙ্গ) নির্গত হয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই ক্ষুদ্র সিগন্যালগুলো দূরবর্তী রেডিও যন্ত্র দিয়েও ধরা সম্ভব, এমনকি পুরু কংক্রিটের দেয়াল ভেদ করেও! আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, এই গুপ্তচরবৃত্তির জন্য প্রয়োজন মাত্র একটি সাধারণ এফএম রেডিও রিসিভার এবং একটি তামার তার (কপার ওয়্যার), যা দিয়ে সহজেই কথোপকথন রেকর্ড করা যায়। আর এই সম্পূর্ণ সিস্টেমটি তৈরি করতে ১০০ ডলারেরও কম খরচ হয়।
প্রথমদিকে এসব রেকর্ডিংয়ের শব্দের মান দুর্বল হলেও, গবেষকেরা প্রমাণ করেছেন যে আধুনিক সফটওয়্যারের মাধ্যমে তা সহজেই স্পষ্ট করা সম্ভব। এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে রেকর্ডিং থেকে নির্দিষ্ট শব্দ বা বাক্য খুঁজে বের করাও সম্ভব হয়েছে।
দোষী কে: MEMS মাইক্রোফোন!
এই সমস্যার মূল উৎস হলো ‘এমইএমএস’ (MEMS) মাইক্রোফোন, যার পূর্ণরূপ মাইক্রোইলেকট্রোমেকানিক্যাল সিস্টেমস। ছোট আকারের এই সস্তা মাইক্রোফোনগুলো প্রায় সব ধরনের আধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইসেই ব্যবহৃত হয় – স্মার্টফোন থেকে শুরু করে ল্যাপটপ, এমনকি হেডফোনেও। শব্দ গ্রহণ করার সময় এই মাইক্রোফোনগুলো থেকে সামান্য রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি (RF) নির্গত হয়, যা ধারণকৃত কথাবার্তার আংশিক তথ্য বহন করে।
গবেষণায় আরও জানা যায়, এমনকি যখন ইউটিউব, স্পটিফাই, আমাজন মিউজিক বা গুগল ড্রাইভের মতো অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা হয় না, তখনও অনেক সময় এগুলো ব্যাকগ্রাউন্ডে মাইক্রোফোন সক্রিয় রাখে। এর ফলে আপনি যখন কথা নাও বলছেন, তখনও আপনার ডিভাইসগুলো ‘শোনে’ এবং রেডিও তরঙ্গ হিসেবে সেই তথ্য ছড়িয়ে দেয়।
ল্যাপটপ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ:
বিভিন্ন ডিভাইস পরীক্ষা করে গবেষকেরা দেখেছেন, ল্যাপটপ এই ধরনের তথ্যের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এর কারণ হলো, ল্যাপটপে মাইক্রোফোন সাধারণত দীর্ঘ তারের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে, যা একটি অ্যানটেনার মতো কাজ করে এবং নির্গত সিগন্যালকে আরও শক্তিশালী করে তোলে, ফলে দূর থেকেও তা সহজে ধরা পড়ে।
সমাধানের আশা:
তবে আশার কথা হলো, এই সমস্যার সমাধানে ব্যয়বহুল প্রযুক্তির প্রয়োজন নেই। গবেষকদের মতে, মাইক্রোফোনের সংযোগ তার ছোট করে দেওয়া বা মাইক্রোফোনকে সার্কিট বোর্ডের আরও কাছাকাছি বসালে নির্গত সিগন্যালের মাত্রা অনেকটাই কমে আসে। একই সঙ্গে, মাইক্রোফোন যেভাবে শব্দ প্রক্রিয়াজাত করে, সেই পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনলেও ফাঁস হওয়া তথ্য বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে।
গবেষকেরা ইতিমধ্যে ইলেকট্রনিক ডিভাইস প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তাদের এই গবেষণা এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে কোম্পানিগুলো এসব সুপারিশ কতটা দ্রুত বাস্তবায়ন করবে, তা এখনো অনিশ্চিত। এই গবেষণা ডিজিটাল যুগে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষায় নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে এবং ব্যবহারকারীদের আরও সতর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে।
তথ্যসূত্র: নোরিডজ সায়েন্স