নিষিদ্ধ সম্পর্কের চোরাবালি! সবংয়ের গৃহবধূ খুনে স্তম্ভিত পশ্চিম মেদিনীপুর, গ্রেফতার জামাইবাবু

পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ে মোহাড় এলাকার নির্জন খালপাড়। ভোরের আলো ফুটতেই এক মর্মান্তিক দৃশ্য: এক গৃহবধূর নিথর দেহ পড়ে আছে। স্থানীয়দের ঘুম ভাঙল এক অজানা আশঙ্কায়, আর সেই আতঙ্ক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রূপান্তরিত হলো তীব্র শোক ও ঘৃণায়। প্রাথমিকভাবে রহস্যময় মনে হলেও, দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, এ নিছকই কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং এক সুপরিকল্পিত খুন। আর এই খুনের নেপথ্যে যে কাহিনি, তা যেন এক নিষিদ্ধ প্রেমের জটিল আখ্যান, যেখানে প্রত্যাখ্যানের বিষাক্ত ছোবল কেড়ে নিয়েছে একটি জীবন।

এক ফোন কল, তারপরই নিস্তব্ধতা

মৃতার স্বামী সবং থানায় অভিযোগ জানানোর পরই তদন্তের গতিপথ স্পষ্ট হতে শুরু করে। তিনি পুলিশকে জানান, রবিবার সন্ধ্যায় একটি অচেনা ফোন কল আসে তাঁর স্ত্রীর কাছে। ফোনকারী ছিলেন এক যুবক, যিনি তাঁর স্ত্রীকে দেখা করতে ডেকেছিলেন। সেই যে বেরিয়ে গেলেন, আর ফিরলেন না গৃহবধূ। সোমবার সকালে তাঁর দেহ উদ্ধার হয় খালধার থেকে। দেহের একাধিক আঘাতের চিহ্নই বলে দিচ্ছিল, কতটা নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশের প্রাথমিক অনুমান, শ্বাসরোধ করে অথবা মাথায় গুরুতর আঘাত করে তাঁকে খুন করা হয়েছে।

নিষিদ্ধ সম্পর্কের চোরাবালি

তদন্তে নেমে পুলিশ যে তথ্য উদ্ঘাটন করেছে, তা স্তম্ভিত করে দিয়েছে সকলকে। জানা গেছে, মৃত গৃহবধূর সঙ্গে তাঁর দূরসম্পর্কের জামাইবাবু এক দীর্ঘদিনের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। একসময় এই সম্পর্কের জেরে তিনি নিজের স্বামী-সংসার ছেড়ে চলেও গিয়েছিলেন। কিন্তু হয়তো অনুশোচনা, হয়তো বা মেয়ে আর স্বামীর প্রতি গভীর টান, একসময় সেই গৃহবধূ ফিরে আসতে চেয়েছিলেন তাঁর পুরোনো জীবনে। স্বামীও উদারতার সঙ্গে তাঁকে গ্রহণ করেছিলেন, নতুন করে সংসার শুরুর স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা দু’জনে।

কিন্তু এই প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি অভিযুক্ত যুবক। পুলিশের সন্দেহ, তাঁর কাছে এটি ছিল ব্যক্তিগত অপমান। এই অপমান ও প্রত্যাখ্যানের জ্বালা থেকেই প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে তাঁর মনে।

অপমানের প্রতিশোধ?

পুলিশের দাবি, রবিবার সন্ধ্যায় সেই যুবকই ফোন করে গৃহবধূকে ডেকে পাঠায়। দেখা করার অজুহাতে তাঁকে নির্জন খালধারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করা হয় বলে অনুমান পুলিশের। টানা জিজ্ঞাসাবাদের পর অভিযুক্ত যুবককে গ্রেফতার করেছে সবং থানার পুলিশ। যদিও অভিযুক্ত সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করছে।

মঙ্গলবার মেদিনীপুর জেলা আদালতে তোলা হলে আদালত তাকে তিন দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে। পুলিশ এই সময়ের মধ্যেই খুনের মূল উদ্দেশ্য (মোটিভ) এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করার চেষ্টা করবে।

শুধু কি একটি খুন?

সবংয়ের এই ঘটনা শুধু একটি খুনের মামলায় সীমাবদ্ধ নেই। এটি আমাদের সমাজের সম্পর্কের জটিলতা, প্রত্যাখ্যানের অসহিষ্ণুতা এবং সবচেয়ে বড় কথা, নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে এক গভীর প্রশ্ন তুলে ধরে। একজন নারী যদি নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি ভুল সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসে নিজের পরিবারে, নিজের ঠিকানায় ফিরে আসতে চান, তা কি তাঁর মৌলিক অধিকার নয়? সেই অধিকারের মূল্য কি তাঁর জীবন দিয়ে চোকাতে হবে? এই প্রশ্নই এখন পশ্চিম মেদিনীপুরের সাধারণ মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

মৃত্যুর আগে ওই গৃহবধূ নতুন করে জীবন শুরু করতে চেয়েছিলেন, তাঁর স্বামীর সঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্ন তাঁকে জীবন দিয়ে কিনতে হলো। এই মর্মান্তিক ঘটনার দ্রুত এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা, যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। সবংয়ের এই খালপাড়ের নিস্তব্ধতা যেন আর কোনো অধুরা স্বপ্নের সমাধি না হয়।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy