বাঙালির পাতে ফিরছে সাধের স্বাদ! দিঘা মোহনায় ১৫ টন ইলিশের আমদানি

বাঙালির পাতে ইলিশ মানে শুধু মাছ নয়, এক আবেগ, এক উৎসব। সেই অপেক্ষার পালা শেষ করে পূর্ব মেদিনীপুরের দিঘা মোহনা বাজার সাক্ষী হলো এক রূপালি বিপ্লবের। গত বুধবার সকালে প্রায় ১৫ টন ইলিশ নিয়ে মৎস্যজীবীদের ট্রলার যখন একে একে বাজারে ভিড় করে, তখন দিঘার আকাশ-বাতাসে ভেসে বেড়ায় ইলিশের সুবাস, আর ভোজনরসিক বাঙালির চোখে-মুখে ফোটে খুশির ঝলক। বছরের এই বিশেষ ক্ষণের জন্য যারা অধীর আগ্রহে বসে ছিলেন, তাদের জন্য যেন এক মহাভোজের ইঙ্গিত নিয়ে এলো এই বাম্পার ফলন।

চম্পা নদীর তীরে উৎসব: দামেও মিলছে স্বস্তি
যেখানে চম্পা নদী আর বঙ্গোপসাগরের আলিঙ্গন ঘটে, সেই দিঘা মোহনা বাজার কেবল মৎস্যজীবীদের উপার্জনের কেন্দ্র নয়, এটি যেন বাঙালির ইলিশ-প্রেমের এক তীর্থক্ষেত্র। প্রতিদিন এই বাজারে সমুদ্রের অগণিত সম্পদ নিলামে ওঠে, ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যের আনাচে-কানাচে, এমনকি দেশের দূরদূরান্তেও। জুন মাসের শুরুতেই ইলিশের এই বিপুল আমদানি স্থানীয় মৎস্যজীবীদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে, জ্বালিয়ে দিয়েছে নতুন আশার আলো।

বুধবার সকালে বাজার ঘুরে দেখা গেল, ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি মাত্র ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, আর ১.২ কেজি ওজনের ইলিশ মিলছে ১,৫০০ টাকায়। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এই দাম সাধারণ ক্রেতাদের জন্য বেশ সাশ্রয়ী। তাই বাজারে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো, অনেকেই মনের সুখে কিনে নিয়েছেন সাধের ইলিশ।

প্রত্যাশার ঢেউ: ‘প্রতি বাঙালির পাতে ইলিশ পৌঁছে দেওয়া লক্ষ্য’
দিঘা ফিশারম্যান অ্যান্ড ফিশ ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক শ্যামসুন্দর দাস জানালেন, “আজ দিঘা মোহনা বাজারে প্রায় ১০-১৫ টন ইলিশ এসেছে। আবহাওয়া খারাপ থাকায় কিছু ট্রলার ফিরে এসেছে, যদিও আবহাওয়া দফতর থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট সতর্কবার্তা ছিল না, তবু সমুদ্র উত্তাল থাকায় মৎস্যজীবীরা ফিরে আসেন। তবে আমরা খুবই আশাবাদী, এই বছর ইলিশের ফলন ভালো হবে। কিছু ট্রলার এখনও সমুদ্রে আছে, তারা ফিরলে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। আমাদের মূল লক্ষ্য প্রতিটি বাঙালির পাতে ইলিশ পৌঁছে দেওয়া। পর্যটকদের জন্যও আমরা সহজে মাছ কেনার ব্যবস্থা রেখেছি।”

মৎস্যজীবী অনন্য বর-এর কথায় ফুটে ওঠে সেই একই আশাবাদ, “আজ আমাদের কাঁটাতে ইলিশ মাছ প্রথম বিক্রি হয়েছে। আমরা আশা করছি আগামী দিনে আরও বেশি পরিমাণে ইলিশ পাব।” তাঁর এই মন্তব্য অন্যান্য মৎস্যজীবীদের মধ্যেও ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছে।

দিঘা মোহনা বাজারে প্রতিদিন গড়ে ৪০০-৪৫০ মেট্রিক টন মাছ বিক্রি হয়, যার মধ্যে ইলিশ ছাড়াও পমফ্রেট, চিংড়ি, কাঁকড়া, ক্যাটফিশ, টুনা এবং শুঁটকি মাছ অন্যতম। প্রায় ১,৪২৫ জন সদস্য এবং প্রায় ২,০০০ মাছ ধরার নৌকা নিয়ে দিঘা ফিশারম্যান অ্যান্ড ফিশ ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডি.এফ.এফ.টি.এ.) এই বিশাল বাজার পরিচালনা করে।

গন্ধময় প্রবেশপথ পেরিয়ে রূপালি আকর্ষণ: পর্যটকদের নতুন ঠিকানা
দিঘা মোহনা বাজার শুধু মাছ কেনাবেচার জায়গা নয়, এটি এখন পর্যটকদের কাছেও এক নতুন আকর্ষণ। সূর্যোদয়ের মায়াবী দৃশ্য উপভোগ করার পর অনেকেই এই বাজারে ভিড় করেন সামুদ্রিক মাছের বৈচিত্র্য দেখতে। যদিও বাজারের প্রবেশপথ কিছুটা কর্দমাক্ত এবং মাছের পরিচিত তীব্র গন্ধ কিছু পর্যটকদের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে, তবুও এর জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি। তাজা মাছের লোভেই স্থানীয় বাসিন্দা এবং পর্যটকরা ছুটে আসেন এখানে।

এই বছর ইলিশের ভালো ফলনের সম্ভাবনা বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করবে। মৎস্যজীবীরা আশাবাদী, সমুদ্রের পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে আরও বেশি ইলিশ ধরা পড়বে। দিঘা মোহনা বাজারের এই প্রাণচঞ্চলতা এবং ইলিশের প্রাচুর্য শুধু ব্যবসার দিক থেকেই নয়, বাঙালির ভোজনবিলাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে আবারও উজ্জ্বল করে তুলেছে। এটি পর্যটকদের জন্যও মৎস্যজীবীদের জীবনধারা ও সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার এক অনন্য সুযোগ।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy