রথযাত্রার নিয়ম ঘিরে দ্বন্দ্ব? ইসকনকে কড়া ভাষায় চিঠি লিখলেন পুরীর রাজা

রথযাত্রা! সারা বিশ্বের বাঙালির কাছে এক আবেগঘন উৎসব। আর এই রথযাত্রা যখন সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক আঙিনায় পা রাখে, তখন তার নিয়ম-নীতি নিয়েই উঠল বড় প্রশ্ন। বিদেশে রথযাত্রা পালনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট তিথি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ইসকনকে কড়া চিঠি পাঠিয়েছেন পুরীর গজপতি মহারাজ দিব্যসিংহ দেব, যা বিশ্বজুড়ে ইসকন ভক্তদের মধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তাঁর স্পষ্ট বার্তা: জগন্নাথদেবের আচার পালন ও রথযাত্রা সংক্রান্ত বিধিগুলি শাস্ত্র অনুমোদিত নির্দিষ্ট তারিখেই অনুষ্ঠিত করতে হবে, কোনওমতেই যেন সেই ঐতিহ্য লঙ্ঘন না হয়।

পিটিআই সংবাদসংস্থায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, পুরীর জগন্নাথ মন্দির কমিটির চেয়ারম্যান গজপতি মহারাজ দিব্যসিংহ দেব ইসকনকে লেখা চিঠিতে জানিয়েছেন, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ইসকন পরিচালিত কিছু মন্দিরে স্নানযাত্রা বা রথযাত্রার মতো অনুষ্ঠানগুলি অন্য তারিখে পালন করা হচ্ছে। বিশেষ করে, জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা অনুষ্ঠান নির্দিষ্ট দিন ছাড়া অন্যান্য দিনে পালিত হয়েছে। ইসকন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় রথযাত্রা পালনের দিনও বদল করেছে। এই পদক্ষেপগুলিতে তিনি গভীরভাবে অসন্তুষ্ট। তাঁর অভিযোগ, এই ধরনের প্রথা নির্দিষ্ট দিনে পালিত হয়। সেটা অন্যদিনে করা ধর্মীয় বিধি লঙ্ঘন।

চিঠিটি পাঠানো হয়েছে মায়াপুরের ইসকন গভর্নিং বডি কমিশনের চেয়ারম্যান শ্রী গোবর্ধন দাস প্রভুকে। চিঠিতে স্পষ্ট অনুরোধ করা হয়েছে, পৃথিবীর কোথাও কোনও ইসকন মন্দির বা ইসকনের কোনও কেন্দ্র যেন শাস্ত্র ও ঐতিহ্য লঙ্ঘন না করে। শাস্ত্র অনুমোদিত নয় এমন তিথিতে যেন জগন্নাথের স্নানযাত্রা বা রথযাত্রা পালন না করা হয়।

তিথি-বিচ্যুতির প্রমাণ ও শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা
গজপতি মহারাজা দিব্যসিংহ দেবের লেখা চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের বাইরে ইসকন দ্বারা চালিত মন্দিরগুলি পবিত্র ধর্মগ্রন্থে অনুমোদিত নয় এমন তারিখ বা তিথিতে স্নানযাত্রা বা রথযাত্রা উদযাপন করছে। তিনি ইসকনের কয়েকটি পোস্টের নথিও শেয়ার করে লিখেছেন, নিউ ইয়র্ক সিটি, ক্যালগারি এবং লিসেস্টারের ইসকন মন্দিরগুলি এই ধরনের তিথি-বিচ্যুতি ঘটিয়েছে।

পুরীর শ্রী জগন্নাথ মন্দির প্রশাসনের বিদ্বান পণ্ডিতরা ২০ মার্চ ভুবনেশ্বরে অনুষ্ঠিত সভায় ইসকন পণ্ডিতদের উত্থাপিত মতামত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখেছেন। তারপরেই পণ্ডিতরা ফের স্পষ্ট করে দিয়েছেন:

স্নানযাত্রা শুধুমাত্র জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা তিথিতে (এই বছর ১১ জুন) পালন হয়েছে।
রথযাত্রা কেবলমাত্র আষাঢ় শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে (এই বছর ২৭ জুন) শুরু হয়ে আষাঢ় শুক্লপক্ষ দশমী তিথি (এই বছর ৫ জুলাই) পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে।
অন্য কোনও তিথিতে এই বিধি পালন করা মানেই নিয়ম লঙ্ঘন।

ইসকনের যুক্তি: বাস্তবতার নিরিখে ভিন্নতা কি অনিবার্য?
পুরীর গজপতি মহারাজের এই চিঠির প্রেক্ষিতে কী বলছেন ইসকন কর্তৃপক্ষ? সংবাদ মাধ্যমে কলকাতা ইসকনের ভাইস প্রেসিডেন্ট রাধারমন দাস বিষয়টি নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন।

তিনি বলেন, “প্রায় ১৫০ দেশে, ৪ হাজারের বেশি শহর ও গ্রামে আমরা রথযাত্রা পালন করি। বিদেশে সাধারণত একই দিনে রথযাত্রা পালন করা সম্ভব হয় না। কারণ বহু দেশে আবহাওয়া অনুকূল থাকে না। অস্ট্রেলিয়াতে জুন-জুলাই মাসে বরফ পড়ে। ফলে ওই সময়ে আমরা সেখানে উৎসব পালনের অনুমতি পাই না। তাই অন্য দিন তা পালন করতে হয়।”

রাধারমন দাসের মতে, গজপতি মহারাজ যা বলেছেন, তা বাস্তবে কতটা সম্ভব, সেটা ভাবনাচিন্তা করার বিষয়। তিনি দুটি পথের কথা উল্লেখ করেছেন: “এক, নিয়ম লঙ্ঘন না করে একই দিনে রথযাত্রা পালন করা। অথবা অনুমতি না পেলে উৎসব বন্ধ করে দেওয়া। সেটা তো সম্ভব নয়।” তিনি আরও যোগ করেন, “অনেক দেশই ছুটির দিন উৎসব পালনের কথা বলে, সেক্ষেত্রে আমাদের দিনক্ষণ এদিক-ওদিক হয়েই যায়। নিয়ম পালন করতে গেলে রথযাত্রাই হবে না।”

ঐতিহ্য বনাম বাস্তবতা: ভবিষ্যৎ কী?
পুরীর গজপতি মহারাজের এই চিঠি এবং ইসকনের যুক্তি, উভয়ই এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এনেছে: প্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্য ও আধুনিক বিশ্বের বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা কতটা সম্ভব? বিশ্বজুড়ে হিন্দু ধর্মের প্রসার এবং একই সাথে প্রতিটি দেশের নিজস্ব নিয়ম-কানুন ও আবহাওয়ার সীমাবদ্ধতা—এই দুইয়ের টানাপোড়েনে রথযাত্রার মতো ঐতিহ্যবাহী উৎসবের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে এখন আলোচনা তুঙ্গে। ইসকন কি তাদের বিশ্বব্যাপী রথযাত্রা পালনের পদ্ধতি পরিবর্তন করবে, নাকি এই বিতর্কের একটি সর্বসম্মত সমাধানসূত্র বেরিয়ে আসবে? সময়ই তা বলবে।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy