বিশেষ: যাঁর নির্দেশ ছাড়া ইরানে পাতাও নড়ে না, কে আয়াতোল্লাহ খামেনেই? জেনেনিন পরিচয়

ইসরায়েল সংঘাতের পারদ যখন ক্রমশ চড়ছে, তখন একটি নাম বারেবারে উঠে আসছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে – আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেই, ইরানের ‘সুপ্রিম লিডার’ বা সর্বোচ্চ নেতা। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরাসরি বলছেন, “ইরানের সঙ্গে কোনো যুদ্ধ হচ্ছে না, এটা আসলে যুদ্ধের শেষ।” কিন্তু এই ‘শেষ’ কেমন? নেতানিয়াহুর দাবি, খামেনেইকে হত্যা করতে পারলেই এই যুদ্ধের চিরতরে অবসান হবে। স্পষ্টতই, ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য এখন ইরানের এই সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান ব্যক্তি। কিন্তু কে এই খামেনেই? কেনই বা একজন ব্যক্তিকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে দুই দেশের ভবিষ্যৎ?

কে এই আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেই?

নেতানিয়াহুর এমন চাঞ্চল্যকর মন্তব্যের পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, কে এই আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেই, যাঁর ওপর এত বড় দাবি করছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী? কেন একজন ব্যক্তিকে নির্মূল করতে পারলেই দুটি দেশের দীর্ঘদিনের সংঘাত থেমে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে?

বর্তমানে ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হলেন আয়াতোল্লাহ সাইয়্যেদ আলি খামেনেই। ১৯৮৯ সাল থেকে তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা পদে অধিষ্ঠিত। তিনি কেবল দেশের রাজনৈতিক প্রধানই নন, ধর্মীয়ভাবেও দেশটির সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের অধিকারী। তাঁর নির্দেশ ছাড়া ইরানে কার্যত পাতাও নড়ে না।

একজন ধর্মগুরুর শীর্ষতম নেতা হয়ে ওঠার পথ

১৯৩৯ সালে ইরানের মাশহাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেই। ছোটবেলা থেকেই তাঁর শিক্ষাজীবন ছিল ইসলামি ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রিক, যেখানে তিনি শিয়া মতবাদের একজন ধর্মগুরু হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। তাঁর রাজনীতিতে আগমন ঘটে ইরানে রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের সময়। তিনি ছিলেন আয়াতোল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনির একজন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ অনুসারী – যিনি ১৯৭৯ সালের ঐতিহাসিক ইরানি ইসলামি বিপ্লবের মূল কান্ডারি।

খোমেইনির নেতৃত্বে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির রাজতন্ত্র উৎখাত হলে ইরানে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন শাসনব্যবস্থায় খামেনেই ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করেন। তিনি ১৯৮১ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ইরানের রাষ্ট্রপতি ছিলেন এবং এর আগে সংসদ সদস্য (মজলিস) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় তিনি খোমেইনির প্রতিনিধি হিসেবে সেনাবাহিনীতে কার্যত তদারকির কাজ করতেন। যদিও সে সময় তাঁর ধর্মীয় পদমর্যাদা ‘হোজ্জাতুল ইসলাম’ ছিল – অর্থাৎ, তিনি তখনও শীর্ষস্থানীয় আয়াতোল্লাহর পর্যায়ে পৌঁছননি।

নাটকীয় উত্থান ও সংবিধানের বদল

১৯৮৯ সালে আয়াতোল্লাহ খোমেইনির মৃত্যুর পর পরিস্থিতি এক নাটকীয় মোড় নেয়। খোমেইনির উত্তরসূরি হিসেবে আগে থেকেই মনোনীত ছিলেন আয়াতোল্লাহ হোসেইন আলি মোন্তাজেরি, কিন্তু খোমেইনির সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

এমন পরিস্থিতিতে ইরানের শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাসেম্বলি অব এক্সপার্টস’ নতুন সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করতে বসে। অপ্রত্যাশিতভাবে, সেখানে অস্থায়ীভাবে খামেনেইকে নেতা হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এই মনোনয়ন ছিল এক সাহসী পদক্ষেপ, কারণ তিনি তখনও ধর্মীয় যোগ্যতা অনুযায়ী শীর্ষ নেতার সব শর্ত পূরণ করতেন না।

এই সংকটময় মুহূর্তে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা হয়। তৎক্ষণাৎ ইরানের সংবিধান বদলে দেওয়া হয়, যাতে সর্বোচ্চ নেতার ক্ষেত্রে ‘মারজায়ে তাকলিদ’ বা সর্বোচ্চ ধর্মীয় ব্যাখ্যাতা হওয়ার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হয়। এই সাংবিধানিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই খামেনেই স্থায়ীভাবে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হয়ে ওঠেন, যা তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

সর্বোচ্চ নেতার ক্ষমতা কতটা?

ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, সর্বোচ্চ নেতা হচ্ছেন দেশের প্রকৃত শাসক। প্রেসিডেন্ট ও সংসদ থাকলেও তাঁদের সকল কার্যকলাপের উপর চূড়ান্ত নজর রাখেন খামেনেই। তাঁর ক্ষমতার ব্যাপ্তি বিশাল:

  • সেনাবাহিনী ও বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (IRGC) নিয়ন্ত্রণ: দেশের সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর তাঁর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
  • বিচারব্যবস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থা: বিচারব্যবস্থা এবং দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সরাসরি তাঁর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।
  • রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও গণমাধ্যম: দেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনসহ অন্যান্য গণমাধ্যম তাঁর নির্দেশনা মেনে চলে।
  • বিদেশনীতি ও পরমাণু কর্মসূচি: ইরানের বিদেশনীতি এবং বিতর্কিত পরমাণু কর্মসূচির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাঁর হাতেই থাকে।
  • নির্বাচন প্রক্রিয়া ও প্রার্থীদের অনুমোদন: নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের যোগ্যতা যাচাই এবং অনুমোদন তাঁর নেতৃত্বাধীন কমিটিগুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
  • এছাড়াও, তিনি দেশের শীর্ষ বিচারপতি, রক্ষণশীল ‘গার্ডিয়ান কাউন্সিল’-এর অর্ধেক সদস্য এবং শুক্রবারের নমাজের ইমামদেরও মনোনয়ন দেন।

বিতর্ক ও কঠোর শাসনের অভিযোগ

আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেইয়ের শাসনকালে ইরানে বহুবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। ২০০৯ সালের ‘গ্রিন মুভমেন্ট’ আন্দোলন বা ২০২২ সালের ‘মাহসা আমিনি’ বিক্ষোভ – সব ক্ষেত্রেই সরকারের কঠোর দমননীতি সামনে এসেছে। ধারণা করা হয়, খামেনেই নিজেই এসব দমননীতির নির্দেশদাতা। নির্বাচনের আগে সংস্কারপন্থীদের প্রার্থিতা বাতিল করেও তিনি সমালোচিত হয়েছেন, যা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আরও সংকুচিত করেছে।

আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেই একাধারে ধর্মীয় নেতা, তীক্ষ্ণ রাজনীতিক এবং কৌশলী রাষ্ট্রনায়ক। তাঁর উত্থান ঘটেছিল বিপ্লবের সময়কার আনুগত্য এবং পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার কুশলী বিন্যাসের মাধ্যমে। সংবিধান বদলে নিজের পক্ষে পরিস্থিতি আনা, শীর্ষ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া এবং দীর্ঘদিনের কড়া শাসনের মাধ্যমে তিনি এখন ইরানের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও শক্তিশালী নেতা। এই প্রেক্ষাপটে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ‘খামেনেইকে হত্যা করলেই যুদ্ধ মিটবে’ এই দাবি মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন কী ঝড় তোলে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy