‘চ্যাটজিপিটির মহামারী’- এবার যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটিতে, জেনেনিন পুরো বিষয়টি কী?

ক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নকলের চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। প্রচলিত পদ্ধতিতে নকল বা কপির হার ব্যাপকভাবে কমে এলেও, চ্যাটজিপিটি ও অন্যান্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ভিত্তিক টুলের মাধ্যমে নকল করে ধরা পড়ার ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের এক অনুসন্ধানে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে, যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

জরিপ বলছে, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে এআইভিত্তিক টুল ব্যবহার করে নকলের প্রমাণ মিলেছে প্রায় সাত হাজার ক্ষেত্রে, যা প্রতি এক হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে গড়ে ৫.১ জন। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২২-২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল প্রতি এক হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ১.৬ জন। মে মাস পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারে, চলতি বছর এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যেখানে প্রতি এক হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে নকলের প্রমাণ পাওয়ার ঘটনা দাঁড়াতে পারে প্রায় ৭.৫ জনে।

হিমশৈলের চূড়ামাত্র? প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, নথিভুক্ত এসব ঘটনা “হিমশৈলের চূড়ামাত্র”, কারণ প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে। এই তথ্যগুলো স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, চ্যাটজিপিটি ও অন্যান্য এআইভিত্তিক লেখার টুলের আবির্ভাবের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দ্রুত পরিবর্তনশীল এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। ফলস্বরূপ, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতির সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নেওয়া যায়, তা নিয়ে তাদের রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে।

নকলের ধরন পরিবর্তন: প্লেজিয়ারিজম থেকে এআই জেনারেটেড কনটেন্ট
২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে জেনারেটিভ এআই এখনকার মতো সহজলভ্য ছিল না। ওই সময় সব ধরনের একাডেমিক অনিয়মের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ছিল সরাসরি নকল বা প্ল্যাজিয়ারিজম। মহামারীর সময় অনেক পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়া শুরু হলে নকলের প্রবণতা আরও বেড়ে যায়। তবে বর্তমানে বিভিন্ন এআই টুল উন্নত ও সহজে ব্যবহারের জন্য পাওয়ার কারণে নকলের ধরনও পাল্টে গিয়েছে বলে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

জরিপে আরও উঠে এসেছে যে, প্রচলিত ধরনের নকলের প্রমাণিত ঘটনা প্রতি এক হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৯ জন থেকে কমে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ১৫.২ জনে দাঁড়িয়েছে। চলতি শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক তথ্য অনুসারে, এই সংখ্যা আরও কমে প্রতি এক হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৮.৫ জনে নেমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

শিক্ষা খাতের অসঙ্গতি ও দুর্বলতা
‘ফ্রিডম অফ ইনফরমেশন অ্যাক্ট’-এর অধীনে যুক্তরাজ্যের ১৫৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে গত পাঁচ বছরে একাডেমিক অনিয়ম, নকল ও এআই সম্পর্কিত প্রতারণার প্রমাণিত ঘটনার পরিসংখ্যান চেয়েছিল গার্ডিয়ান। যার মধ্যে কেবল ১৩১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য পেয়েছে ব্রিটিশ দৈনিক পত্রিকাটি। কারণ, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে প্রতিটি বছরের বা অনিয়মের ধরন অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড ছিল না।

যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের তথ্য দিয়েছে, তাদের মধ্যে ২৭ শতাংশেরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় এখনও এআই অপব্যবহারের বিভিন্ন ঘটনাকে একাডেমিক অনিয়মের আলাদা শ্রেণি হিসেবে রেকর্ড করেনি। এর থেকে ইঙ্গিত মেলে যে, এখনও এই নতুন সমস্যাটি পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি বা এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে শিক্ষা খাত।

এআই ডিটেকশনের সীমাবদ্ধতা: একটি বড় চ্যালেঞ্জ
এআই ব্যবহার করে নকলের অনেক ঘটনা হয়তো এখনও ব্যাপকহারে ধরা পড়ছে না। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ‘হায়ার এডুকেশন পলিসি ইনস্টিটিউট’-এর এক জরিপে উঠে এসেছে, ৮৮ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের মূল্যায়নের কাজে এআই ব্যবহার করেছে। গত বছর ‘ইউনিভার্সিটি অফ রিডিং’-এর গবেষকেরা নিজেদের মূল্যায়ন পদ্ধতির ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, শিক্ষার্থীরা যেসব কাজ এআই দিয়ে তৈরি করে জমা দিয়েছিলেন, ৯৪ শতাংশ ক্ষেত্রেই তা ধরা যায়নি।

‘ইউনিভার্সিটি অফ রিডিং’-এর মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও এ গবেষণার সহলেখক ড. পিটার স্কার্ফ বলেছেন, “সব সময়ই নকল করার কোনো না কোনো উপায় ছিলই। তবে এআই নিয়ে শিক্ষা খাতকে অবশ্যই মানিয়ে নিতে হবে। কারণ, একেবারেই ভিন্ন ধরনের একটি চ্যালেঞ্জ এনেছে এআই।”

তিনি আরও বলেন, “আমার ধারণা, যারা ধরা পড়ছেন তারা হিমশৈলের চূড়ামাত্র, মোট ঘটনার খুব সামান্য অংশই মাত্র তারা। এআই শনাক্তকরণ প্রচলিত নকলের থেকে অনেক আলাদা। কারণ প্রচলিত নকলে আপনি সরাসরি কপি করা লেখাকে চিনতে পারবেন। তবে কে এআই ব্যবহার করেছে এমন সন্দেহ হলে তা প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। এমনকি এআই ডিটেক্টর ব্যবহারের বেলাতেও। কারণ, এআই ডিটেক্টর কেবল কিছু শতাংশই শনাক্ত করতে পারে।”

“প্রতিটি পরীক্ষা সরাসরি শিক্ষার্থীদের সামনে বসিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তবে একইসঙ্গে শিক্ষা খাতকে মেনে নিতে হবে শিক্ষার্থীরা এআই ব্যবহার করবে, এমনকি নিষেধ করলেও। আর সেটা অনেক সময় ধরাও পড়বে না।”

যুক্তরাজ্যের সরকারি একজন মুখপাত্র বলেছেন, সরকার জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিতে ১৮ কোটি ৭০ লাখ পাউন্ডের বেশি বিনিয়োগ করছে ও বিভিন্ন স্কুলে এআই ব্যবহারের বিষয়ে নির্দেশিকাও প্রকাশ করেছে।

“শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে জেনারেটিভ এআইয়ের। তবে শিক্ষাদান, শেখা ও মূল্যায়নের সঙ্গে এআইকে যোগ করতে হলে সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাবতে হবে কীভাবে এর নানা সুবিধা কাজে লাগিয়ে ঝুঁকি কমিয়ে আনা যায়, যাতে ভবিষ্যতে চাকরির জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করতে পারে এসব বিশ্ববিদ্যালয়।”

শিক্ষাক্ষেত্রে এআইয়ের প্রভাব নিঃসন্দেহে আগামী দিনগুলোতে আরও বড় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠবে, কারণ প্রযুক্তি যত এগোবে, তার চ্যালেঞ্জগুলোও ততটা জটিল হবে।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy